দৌড়ে এল মুসা। কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে সময় যেন স্থির হয়ে গেল। ঘোরের মধ্যে যেন মূসাকে দড়ি কাটতে দেখল কিশোর। মুক্ত হওয়ার পর আর একটা সেকেণ্ড দেরি করল না। লাফ দিয়ে উঠে প্রায় ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়ল ঘড়িটার কাছে। হ্যাঁচকা টানে ঘড়ির সঙ্গে যুক্ত বোমার তারগুলো ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন করে দিল। এতক্ষণ পর রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে পায়ে। বিচিত্র একট যন্ত্রণা। শরীরের ভার রাখতে পারল না আর পা দুটো। ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে।
ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
ঢঙঙ! ঢঙঙ! টঙঙ!
তিনবার বাজল ঘণ্টা। কিছুই ঘটল না। স্বস্তিতে চোখ মুদল কিশোর।
দড়ি কেটে অন্য দুজনকেও মুক্ত করে ফেলল মুসা।
গোটা দুই গোঙানি দিয়ে উঠে বসল গোরো। কাঁপা খসখসে গলায় বলল, আহ, বাঁচালে! ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছ নাকি তুমি!
চেয়ারে বসে থেকেই রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিল রবিন। তবে মুখে গোঁজা কাপড়টা টেনে খুলে ফেলল। কোটি কোটি ধন্যবাদ দিলেও ওর ঋণ শোধ করতে পারব না আমরা! যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনেছে!
দুই হাত তুলে নাড়তে লাগল মুসা, আরি বাবারে, থামো না! প্রশংসার। ঠেলায় তো পাগল হয়ে যাব! হয়েছিলটা কি?
আমাদের কথা বলার অবস্থা নেই এখন। তুমি কি করে এলে, আগে সেই কথা বলো।
সন্ধ্যায় স্যালভিজ ইয়ার্ডে গিয়ে শুনলাম, দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে গেছ। অপেক্ষা করতে লাগলাম। যতই রাত হতে লাগল, তোমরা ফিরলে না, মেরি আন্টির সঙ্গে সঙ্গে আমারও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। মাঝরাতেও যখন দেখা নেই তোমাদের, আর থাকতে পারলেন না আন্টি। পুলিশকে ফোন করলেন। ওরাও কিছু বলতে পারল না। ইয়ান ফ্লেচার অফিসে নেই। যে অফিসার ধরল, সে কথা দিল খুজতে বেরোবে। তবে কখন বেরোতে পারবে, বলতে পারল না। অস্থির হয়ে পড়লাম। হঠাৎ করেই মনে হলো রিভেরা হাউসের কথা। তাই তো, ওখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়েনি তো!
এটা ভাবার জন্যে আরেকবার তোমাকে ধন্যবাদ, মুসা, কিশোর বলল। এই কালো জিনিসটা দেখছ? একটা সাংঘাতিক বোমা। তুমি আসতে যদি আর কয়েক মিনিট দেরি করতে, এতক্ষণে এই বাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম। ই খাইছে! ভয়ে ভয়ে বাক্সটার দিকে তাকাতে লাগল মুসা, বলো কি! এই শয়তানিটা কে করল? ফাটার ভয় নেই তো আর?
না, নেই, মাথা নেড়ে বলল গোরো। দুর্বল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। বোমাটা নেয়ার জন্যে এগোল।
আপনি ঠিক আছেন তো, মিস্টার কিনডার? সাংঘাতিক জোরে মেরেছে। আপনাকে উইক শয়তানটা!
আমি ঠিকই আছি। তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমরা না থাকলে আজ আমাকে মরতে হত। আমাকে ভেতরে রেখে বোমা ফিট করে চলে যেত। সব আমার দোষ। ওর কথা বিশ্বাস করে এত ভয়ঙ্কর একটা জিনিস বানীতে গেলাম কেন?
আপনি তো আর খারাপের জন্যে বানাননি, ভালর জন্যে বানিয়েছেন। উইক যে আপনার সঙ্গে বেঈমানি করবে, ওদের শয়তানির সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে দেয়ার জন্যে বাড়ি উড়িয়ে দিতে চাইবে, সেটা জানতেন না। অতএব দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া আমাদের কোন ক্ষতিও হয়নি। বহাল তবিয়তে আছি সবাই।
এইবার বলে ফেলো তো সব, তাগাদা দিল মুসা। আর টেনশনে থাকতে রাজি নই।
সে-সব পরে শুনলেও হবে। বিপদ এখনও শেষ হয়নি। লুকিয়ে পড়তে হবে আমাদের। নিশ্চয় দূরে কোথাও অপেক্ষা করবে উইক, দেখবে বাড়িটী ধ্বংস হলো কিনা। বোমা ফাটার শব্দ না পেলে কি হলো দেখার জন্যে আবার ফিরে আসতে পারে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, তাই তো! এ কথা তো ভাবিনি! ওর কাছে পিস্তল থাকতে পারে। এবার এলে আর বাঁচতে দেবে না আমাদের।
উদ্বিগ্ন হলো মুসা, কোথায় লুকাব?
গুপ্তঘরটার দিকে হাত তুলল কিশোর।
ঘড়ির পেছনের ফোকরটা এতক্ষণ নজরে পড়েনি মুসার। দেখে হাঁ হয়ে গেল। খাইছে! ওটা আবার কি?
এসো। গেলেই দেখবে।
ছেলেদেরকে টর্চ জ্বালতে বলে সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিল গোরো। সবাইকে নিয়ে গুপ্তঘরটার দিকে এগোল। সবার শেষে ঢুকল রবিন। কি করে ফোকরের দরজা বন্ধ করতে হবে, বলে দিল গোরো। বন্ধ করল রবিন। সামান্য ফাঁক রেখে দিল, বাইরের ঘরে কি ঘটছে দেখার জন্যে।
.
২৩.
ঘরটা দেখল ছেলেরা। বেশ বড়। মোটা পাইপ দিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মনে হলো, অন্য গুপ্তঘরটাও রয়েছে এটার ঠিক ওপরে। টর্চের আলোয় দেখা গেল কিছু আসবাব, কাজের বেঞ্চ, কিছু যন্ত্রপাতি, একটা হট প্লেট আর একটা খুদে রেফ্রিজারেটর।
বাহ, সুবিধা তো ভালই আছে, রবিন বলল।
এটা আমার ল্যাবরেটরি, গোরো বলল। খারাপ বলা যাবে না।
দরজার কাছে ঘাপটি মেরে রইল ওরা। ইয়ার্ড থেকে বেরোনোর পর যা যা ঘটেছে, মুসাকে বলার সুযোগ পেল রবিন আর কিশোর।
তিনজনে মিলে ভাবতে লাগল, ককার কোথায় আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িটা খুঁজে দেখার জন্যে বেরোতে সাহস পেল না। বসে আছে উইকের অপেক্ষায়।
থেমে এসেছে বিদ্যুৎ চমকানো। বজ্রপতি আরও আগেই বন্ধ হয়েছে। অন্ধকার নিঃশব্দতার মধ্যে এখন বেশি করে কানে বাজছে:
টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!
কিন্তু শব্দটা এখন কিশোরদের কাছে ভীতিকর নয়।
হঠাৎ স্নায়ু টানটান হয়ে গেল ওদের। সামনের দরজা খোলার শব্দ শুনেছে। লিভিং রুমে ঢুকল পদশব্দ। আলো জুলল।
দরজার ফাঁকে চোখ রাখল রবিন। মোলায়েম গলায় বলল, উইক!