ওদের ব্যর্থ হতে দেখে মজা পাচ্ছে যেন উইক। বলল, কি করে এই গুপ্তঘরটা আবিষ্কার করলাম, জানার কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয়? সে-জন্যে গোরোকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
কি করে চোরাই মাল লুকানোর জন্যে একটা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে রিভেরা হাউসটার ওপর চোখ পড়ে উইকের, খুলে বলল। মাল রাখতে এসেই একদিন দেখা হয়ে গেল গোরোর সঙ্গে।
গোরো বলল, সে নাকি ফ্রান্সিস রিভেরার খালাত ভাই। ছোটবেলা থেকেই এ বাড়ির সবখানে খেলা করেছে, গুপ্তঘরগুলো সব চেনে। ঘড়ি-ঘরে ঢোকার একটা চাবিও আছে তার কাছে। আবিষ্কারের নেশা আছে তার। রিভেরা মারা যাওয়ার পর তার মনে হলো, তাই তো, গুপ্তঘরটায় গিয়ে গবেষণা করলে তো মন্দ হয় না। বিরক্ত করতে আসবে না লোকে। মন দিয়ে কাজ করা যাবে। সেজন্যেই এসেছিল। দেখা হয়ে গেল আমার সঙ্গে।
আমি ভাবলাম, তাকে কাজে লাগানো দরকার। ঘরটা খুলে দিতে সে আমাকে সাহায্য করবে। সেই ঘরে মাল রাখলে নিজের অজান্তে সেগুলো পাহারাও দেবে। তাকে লোভ দেখলাম, আমি একটা ল্যাবরেটরি বানিয়ে দিতে পারি। নতুন ধরনের যে কোন আবিষ্কার করতে পারলে সেটা বাজারজাত করতে সাহায্য করতে পারি। আমার টোপ গিলে নিল সে।
তারপর থেকে নিশ্চিন্তে ওখানে চোরাই মাল রাখতে লাগলাম। গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকত গোরো। আমি কি এনে রাখলাম না রাখলাম তা নিয়ে মাথা ঘামাত না। চোখ তুলেও দেখত না। ভালই চলছিল। বাদ সাধল একদিন ককার। বাড়িটা কিনে নিল। বিপদে পড়ে গেলাম। তাকে না তাড়ালেই নয়। হুমকি দয়ে নোট লিখে রেখে এলাম তার গুপ্তঘরে। সেগুলো পেয়েই সে তোমাদের ডেকে আনল।
দম নেয়ার জন্যে থামল উইক। শয়তানি হাসি ফুটল চোখের তারায়। নিশ্চয় ভাবছ, কি করে ওই বদ্ধ ঘরে নোট রেখে এলাম? সে কথা বলছি না। তোমাদের। এই একটা কৌতূহল নিয়ে মরতে হবে তোমাদের, কোনদিনই জানতে পারবে না।
হ্যারিস এসেছিল যে রাতে, সে-রাতে একটা ভয়ানক চিৎকার শুনেছ তোমরা। আমিই করেছি চিকরিটী। ভয় দেখিয়ে বুড়োটাকে তাড়ানোর জন্যে। যে ভাবে ছোঁক ছোঁক করছিল, ওকে তাড়ানোর আর কোন উপায় ছিল না।
ঘড়ির দিকে তাকাল উইক। দুটো বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। আপন মনেই বলল, নাহ, আর দেরি করা যায় না। এবার যেতে হয়। সময় থাকতেই দূরে সরে যাওয়া উচিত।
ঘড়ির পেছনের গুপ্তঘরটায় গিয়ে ঢুকল সে। বাক্স ফেলার শব্দ কানে আসতে লাগল গোয়েন্দাদের। কয়েক মিনিট পর ক্যানভাসের একটা বড় ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল উইক।
বাইরে ঝিলিক দিয়ে উঠল তীব্র আলো। মূহর্ত পরে বজ্রপাতের বিকট শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বাড়িটা। তারপর নামল বৃষ্টি। মুষলধারে।
ঝড় আসছে, উইক বলল। এবার বিদায় নিতে হয় তোমাদের কাছে। এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল সে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা। পান্নাগুলো কোথায় আছে ভাবছ তো? কাঁধের ব্যাগটাতে চাপড় দিল সে। এটার মধ্যে। আলোটা জ্বেলে রেখে যাচ্ছি যাতে ঘড়ির কাঁটা দেখতে পাও। চলি। গুডবাই।
বেরিয়ে গেল সে। সামনের দরজা খুলে বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল।
বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।
তারমধ্যেও কানে আসছে বিশাল ঘড়িটী চলার জোরাল শব্দ:
টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!
.
২২.
সময় কাটছে। কাটছে না বলে বলা যায় উড়ে চলেছে। এমনই হয়। সময় দ্রুত কাটার জন্যে যখন অপেক্ষা করে মানুষ, তখন মনে হয় কাটছেই না। বড় ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। আর এখন যখন ওরা চাইছে না কাটুক, তখন যেন ছুটছে ঘড়ির কাটা।
কি করে যে পৌনে তিনটে বেজে গেল, টেরই পেল না।
জানোয়ার! দাঁতে দাঁত চাপল কিশোর। এ ভাবে আমাদেরকে ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্যে ফেলে গেল!
হাতে-পায়ে কেটে বসছে দড়ি। মরিয়া হয়ে টানাটানি শুরু করল ঢিল করার জন্যে। সেই একই অবস্থা। লাভ হলো না। সামনের দিকে ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করল নিজেকে, যাতে চেয়ার নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে। যাতে বোমাটার কাছাকাছি যেতে পারে।
এতেও কাজ হলো না।
রবিন শরীর মোড়ামড়ি করে হাতটাকে নিয়ে যেতে চাইছে তার পকেটের পেন্সিল কাটার ছোট ছুরিটার কাছে। সেটা আরও অসম্ভব মনে হলো। পকেটের ধারেকাছেও যাচ্ছে না আঙুল।
চুপ করে একই ভাবে পড়ে আছে গোরা। মেনে নিয়েছে যেন এই ভয়াবহ পরিণতি। এই অবস্থার জন্যে মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করছে। কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
এগিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা।
আতঙ্কিত চোখে দেখল ছেলেরা, তিনটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!
চেয়ারে হেলান দিল ওরা। ধসে পড়ল যেন শরীরটা। হাতলের ওপর ঢিল হয়ে গেল আঙুলগুলো। আর কোন আশা নেই!
প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। কাঁপিয়ে দিল বাড়িটাকে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল শব্দ। সামনের বড় জানালাটায় দৃষ্টি যেন আটকে গেছে রবিনের। একটা নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে যেন।
দূর, আতঙ্কে মাথা গরম হয়ে গেছে!–ভাবল সে।
কিন্তু চোখ সরাতে পারল না। তারপর যা দেখল, বিশ্বাস করতে পারল না নিজের চোখকে। কাচের ওপাশে একটা মুখ। অতি পরিচিত। মুসার!
হাঁ করে তাকিয়ে আছে রবিন।
ঝনঝন করে জানালার কাচ ভাঙল। পাল্লা খুলে ঘরে ঢুকল মুসা।
ঘড়ি দেখল কিশোর। আর মাত্র দুই মিনিট। বলল, জলদি করো মুসা! চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করল, কিন্তু জোর নেই গলায়। বোমা লাগানো আছে! দুই মিনিট পরেই ফাটবে! রবিনের পকেটে ছুরি আছে! আগে আমার দড়ি কাটো!