অনেক সময় খেয়ে নিয়েছে গাড়িটা। বিকেল শেষ। গোধূলিও শেষ হয়ে গেল দ্রুত। ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে হাঁটার পর ম্যানিলা রোডের মোড়ে এসে পৌঁছল ওরা। রিভেরা হাউসে যখন ঢুকল, অন্ধকার হয়ে গেছে। ঢুকতে বাধা দিল না ওদের কেউ, কোন পুলিশম্যানকে দেখা গেল না আশেপাশে।
সোজা সেলারে ঢোকার মুখের দিকে এগোল কিশোর। ভাগ্যিস, চাবিটা ছিল সঙ্গে।
আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল। ঢাকনার তালায় চাবি ঢোকাল সে। সেলারে নেমে অন্য সিঁড়িটী বেয়ে রবিনকে নিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। ভেবেছিল দরজায় তালা লাগানো দেখতে পাবে। ভেঙে কিংবা অন্য কোন ভাবে খুলতে হবে। কিন্তু অবাক হলো। দরজাটা ভোলা।
ভালই হলো। পরিশ্রম বাঁচল। ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।
অন্ধকারে পা টিপে টিপে লিভিং রুমের দিকে এগোল। কিছুদূর যেতে না যেতেই কিশোরকে চেপে ধরল অসাধারণ শক্তিমান দুটো হাত। ফেলে দিল মেঝেতে। আরেকটী দেহ পড়ার শব্দ কানে এল তার। নিশ্চয় রবিনকেও ফেলেছে।
দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ওরা। তবু বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। টিকতে পারল না। মাথায় কঠিন কিছুর বাড়ি খেয়ে আধাবেহুশ হয়ে গেল কিশোর। টেনে এনে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে হাতল আর পায়ার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ফেলা হলো। রুক্ষ হাতে মুখে ঠেসে দেয়া হলো কাপড়। একপাশে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল, রবিনকেও কাবু করে ফেলা হচ্ছে।
তারপর নীরবতা। কানে আসতে লাগল এ্যাণ্ডফাদার কুকটার একটানা। একঘেয়ে শব্দ:
টিক-টক। টিক-টক! টিক-টক!
মাথার মধ্যে এখনও কেমন করছে তার, ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। এরই মধ্যে ভাবল, রবিন কি এ ঘরেই আছে? না অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাকে?
.
২০.
কানে এল পা টেনে টেনে হাঁটার আওয়াজ। ভারি নিঃশ্বাস ফেলছে কেউ। জ্বলে উঠল একটা মান আলো। পুরো দৃশ্যটা দেখতে পেল কিশোর।
লিভিং রুমে রয়েছে সে। জানালার ভারি পর্দাগুলো টেনে দেয়া হয়েছে। এককোণে টিক টিক করে চলছে গ্র্যাণ্ডফাদার কুক। রবিনকেও তারই মত বেধে বসিয়ে রাখা হয়েছে পুরানো আমলের একটা পিঠ উঁচু চেয়ারে।
ওদের সামনে দাঁড়ানো লম্বা, বিশালদেহী একজন লোক। চোখে চশমা। ককারের মতই দেখতে অনেকটা, তবে ককার নয় সে। নিজের পরিচয় দিল উইক শিপরিজ বলে।
তাহলে এই লোকই সেই লোক, বন্দর-চোরদের দলপতি! ভাবল রবিন। মাথায় বাড়ি মেরে আমাদের কাবু করে চেয়ারে এনে বেঁধেছে। শয়তান কোথাকার!
একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাতে লাগল উইক। বাঁকা হাসি হেসে বলল, অবাক হয়েছ, না? অন্যের কাজে নাক গলানোর শাস্তি এবার পাবে তোমরা।
রাগ চেপে চুপ করে রইল রবিন।
আজকের সন্ধ্যায় তোমাদের জন্যে অনেকগুলো চমকের ব্যবস্থা করেছি। আমি। তোমাদের বন্ধু অ্যাক্সে ককারও সে-সব উপভোগ করবে। গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে চোখ টিপল সে। তোমরা ভেবেছিলে, দুনিয়ায় একমাত্র তোমরাই চালাক। বোকা আর কাকে বলে। তোমরা কি জানো, যতবার এখানে এসেছ তোমরা, পুলিশ এসেছে, তোমাদের ওপর চোখ রাখা হয়েছে?
যদিও ভয় যে পেয়েছে এটা বুঝতে দিল না কিশোর কিংবা রবিন, বুঝতে পারল সাংঘাতিক চালাক এক খেপা অপরাধীর পাল্লায় পড়েছে এবার। ভেবে অবাক হলো, তাদের ওপর নজর রাখার কাজটা কে করেছে?
ঘড়ির দিক থেকে একটা চি-চি স্বর শোনা গেল। ঘুরে তাকলি উইক, গোরো, বেরিয়ে আসুন। মেহমান এসেছে।
তাজ্জব হয়ে দেখল দুই গোয়েন্দা ঘড়িটী তার পেছনের দেয়ালের খানিকটা অংশ নিয়ে পাশে সরতে আরম্ভ করেছে।
দরজা! চাপা গলায় নিজেকেই যেন বলল কিশোর, ঘড়ি দিয়ে আড়াল করা ছিল! নিশ্চয় দরজা খোলার গোপন সুইচ আছে!
বেরিয়ে এল সাদা-চুল এক বৃদ্ধ। নিখুঁত করে দাড়ি কামানো, নীল চোখ। এগিয়ে এসে ছেলেদের সামনে দাঁড়াল। অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল, মিস্টার শিপরিজ, মেহমান হলে ওদের বেঁধে রাখা হয়েছে কেন? আপনি তো বলতেন বিরক্ত করার জন্যে এখানে ঢোকে ওরা। ক্ষতির ভয়েই তো কড়া নজর রাখতাম
অবাক লাগল কিশোরের। রবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে-ও অবাক হয়েছে। উইকের দলে কাজ করে এই লোক? ঠিক মানায় না।
সময় হলেই সব বুঝবে, গোরো, উইক বলল। গোয়েন্দাদের অবাক হয়ে বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল। ওহ, পরিচয় করানো হয়নি। ওর নাম গোরো কিনডার। একজন আবিষ্কারক। খুব বুদ্ধিমান।
আস্তে মাথা ঝাঁকাল গোরো। উইক, আপনি বলেছেন এরা আপনার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিতে চায়। কিন্তু আমার কাছে তো নিরীহ ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না…
আপনার মনে হওয়া নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই! কর্কশ গলায় বলল উইক। কাজটা শেষ হয়েছে?
হয়েছে হয়েছে, তাড়াতাড়ি বলল গোরো, শেষ হয়ে গেছে। অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।
কে উত্তেজিত হচ্ছে! খেঁকিয়ে উঠল উইক। যান, নিয়ে আসুন।
তাড়াহুড়ো করে গুপ্তপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল গোরো।
ছেলেদের দিকে ফিরল উইক। খুব চমকে গেছ, না? এ বাড়িতে একটা নয়, দুটো গোপন ঘর আছে, সেটা নিশ্চয় জানা ছিল না তোমাদের। তোমরা যখন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজাখুজি করে গেলে, তখন আমি চুপ করে বসেছিলাম ওই ঘড়ির পেছনের ঘরে। আজ সকালে যখন পুলিশ এল, তখনও ছিলাম।
নিজের মাথা ভাঙতে ইচ্ছে করল কিশোরের। ঘড়িটা দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল, যতবার ওটার দিকে চোখ পড়েছে, ততবারই মনে হয়েছে কোন একটা রহস্য আছে ওটীর। তারপরেও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল না কেন!