নিচের দিকে চোখ পড়তে আচমকা থেমে গেল কিশোর। মুসা, দেখো!
কি? ঘন হয়ে জন্মানো ঘাসের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে পেল না মুসা।
লম্বা ঘাসের ডগা সরিয়ে মাটি দেখাল কিশোর। এইবার দেখেছ? পায়ের ছাপ। কাল রাতে এসেছিল এখানে কেউ। হেঁটেছিল। দেখছ না, ঘাসের ডগা ভাঙা? শিশির পড়ে মাটি ভিজে নরম হয়ে গিয়েছিল তখন।
খাইছে, কিশোর, তোমার ওগুলো চোখ না, এক্স-রে মেশিন!
মুসার কথার জবাব না দিয়ে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগোতে শুরু করল কিশোর। চত্বর পেরিয়ে চলে এল ঘন গাছের জটলার দিকে। নদীর দিকে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। পায়ের ছাপ সেদিকেই গেছে।
মাছ ধরতে এসেছিল বোধহয় কেউ, অনুমান করল মুসা।
কি জানি! কথাটা ঠিক মেনে নিতে পারল না কিশোর।
ঘুরতে ঘুরতে এসে একখানে মিলিত হলো আবার চারজনে।
কিছু পেলে? রবিনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। সামনের দরজার তালায় আঁচড়ের দাগ। দেখলাম। অন্ধকারে কেউ খোলার চেষ্টা করেছিল মনে হয়।
পায়ের ছাপের কথা জানাল কিশোর। মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু পেলাম না। এতে বোধহয় সন্তুষ্ট করা যাবে না মিস্টার ককারকে।
আর কি দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি? টমের প্রশ্ন।
বুড়ো রিভিয়েরার ভূত, হেসে বলল টম।
দূর, ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না তো! হাত নেড়ে বলল মুসা। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। খিদেয় পা কাঁপছে।
হেসে ফেলল সবাই।
পাথরের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করল রবিন, এতবড় বাড়ি, এত পুরানো, খালি পড়ে আছে ভাবতে পারছি না। এই মুহূর্তে ভেতর থেকে কেউ গোপনে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে জানলেও অবাক হব না।
হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। পায়ের ছাপ আর তালায় আঁচড়ের দাগকে উড়িয়ে দিতে পারছি না। নিশ্চয় কোন মানে আছে এ সবের। ককারকে বলব। দেখি, কি বলেন।
মাথার ওপরের শূন্য, কালো জানালাটার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি দেখা দিল মুসার চোখে। দেখো, এ সব শুনতে একটুও ভাল লাগছে না আমার। আমি গেলাম!
গেটের দিকে হাঁটা দিল সে। হেসে তার পিছু নিল টম আর রবিন। কিশোরও চলল, তবে সে চিন্তিত। হাসিতে যোগ দিতে পারছে না। নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোন রহস্য আছে বাড়িটীর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন ককারের সঙ্গে কথা বলতে চায়। বাড়ি ফিরেই যোগাযোগ করতে হবে।
বাইরে এসে গেটটা লাগিয়ে দিল সে। চাবি নেই, তালা দিতে পারল না।
ম্যানিলা রোডে ফিরে এল ওরা। ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ।
ওরকম একটা পোড়ো বাড়ির প্রতি আগ্রহী হলেন কেন ককারের মত একজন ব্যাংকার? রবিনের মাথা থেকেও ভাবনাটা যাচ্ছে না।
বাবারে, ওসব কথা বাদ দাও না এখন! বাধা দিল মুসা। খাওয়ার জন্যে বসার জায়গা দেখো।
খোঁচা দিল টম, খাওয়ার পর ঘুমের জায়গা লাগবে না?
দেখো, ইয়ার্কি মেরো না। খাওয়া ছাড়া কেউ বাঁচতে পেরেছে? ঘুম ছাড়া কারও শরীরের ক্ষয় পূরণ হয়েছে?
তা হয়নি। তবে তোমার পূরণটা আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে। বয়েসের তুলনায় দৈত্য।
জবাব দিল না মুসা। চারপাশে তাকিয়ে জায়গা খুঁজতে শুরু করেছে তার চোখ। রিভেরা এস্টেট পেছনে ফেলে এসেছে। ডানে উঠে গেছে ঘন বনে ছাওয়া পাহাড়ের ঢাল। বায়ে গমের খেত, শস্য কাটার পর খড়গুলো এখন রোদে শুকিয়ে বাদামী হয়ে গেছে। খেতের প্রান্তে বিশাল এক ওক গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ছায়া ফেলেছে, লোভ দেখাচ্ছে যেন ওদের।
জায়গা পাওয়া গেছে, হতি তুলে দেখলি মুসা। প্রথমে খাওয়া, তারপর ঘুম।
মাথা নাড়ল টম, ওখানে হবে না।
কেন? ভুরু কোঁচকাল মুসা।
পানি নেই।
তাই তো! সুতরাং পানির জন্যে আরও আধঘণ্টা হাঁটতে হলো ওদের। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নাটা চোখে পড়ল মুসার। সবুজ তৃণভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে টলটলে পানির নহর।
আহ, দারুণ!
দারুণ তো বুঝলাম, রবিন বলল, বসবে কোথায়? ছায়ার তো চিহ্নও নেই এখানে।
দুর! খালি বাগড়া দেয়! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিন্তু ছায়া না থাকলে যে বসা যাবে না, মনে মনে এ কথাটা সে-ও স্বীকার করল।
আবার হাঁটতে হলো। দুই ধারে চেপে আসতে শুরু করল বন। ছোট একটা খাড়ির ধার দিয়ে গেছে পথ। ওপর থেকে গর্তে ঝরে পড়ছে ঝর্না।
খুশি হলো মুসা। বসার এত চমৎকার জায়গা আর পাওয়া যাবে না। গাছের ছায়া আছে, রোদ আছে, পানিও আছে। আর কি চাই!
বসে পড়ল ওরা। ব্যাগ খুলে ডিম আর মুরগীর মাংসের পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচ বের করল মুসা। আর আছে আপেলের জেলি, চকোলেট কেক এবং ফ্লাস্ক ভর্তি বরফ মেশানো দুধ।
খাওয়ার জন্যে মুসাই তাগাদা দিয়েছে বেশি। কিন্তু খেতে বসে আবিষ্কার করল অন্য তিনজন, ওদেরও খিদে পেয়েছে ভীষণ। দেখতে দেখতে সাবাড় করে ফেলল সমস্ত খাবার। ঝর্না থেকে পানি খেয়ে এসে গাছের ছায়ায় যার যে ভাবে ইচ্ছে শুয়ে পড়ল।
চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে কিশোর। গাছের ডালে শিস দিচ্ছে একটা। নাম না জানা পাখি। আরেকটা ছোট আকারের সবুজ পাখি ডাল থেকে মাঝে মাঝেই শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে পোকা শিকার করছে। ফড়িং উড়ছে নানা রঙের।
আহ্, এই তো জীবন! আবেশে চোখ মুদে এল তার।
.
০৩.
ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল ওদের।
রকি বীচে ফিরে মুসা আর টম চলে গেল বেসবল প্র্যাকটিস করতে। রবিন আর কিশোর ইয়ার্ডে ফিরে এল।
মেরিচাচী জানালেন, মিস্টার ককার এসে বসে আছেন অনেকক্ষণ।