শব্দটা তার কানেই আগে ঢুকল। দাঁড়িয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওপরতলায় কেউ আছে!
কথা শোনা গেল। মেঝেতে বসানো কাঠের ঢাকনা তোলার শব্দ হলো।
চোর হলে কেয়ার করি না, ঢোক গিলল মুসা, কিন্তু অন্য কিছু হলে…
তাকে কথা শেষ করতে দিল না রবিন। চলো, দেখি।
সিঁড়ির মাথার দরজাটায় তালা দেয়া।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, আমরা ঢুকতে না পারলেও ওদেরকে বের করে আনতে পারি। চেঁচাও। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করো। বেরোতে বাধ্য হবে ব্যাটীরা।
চেঁচাতে শুরু করল তিনজনে। সেই সঙ্গে থাবা আর কিল মারতে লাগল দরজায়। মিনিটখানেক পরেই দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কথা শোনা গেল, অ্যাই, কে, বলো তো! নিশ্চয় পুলিশ! পালাও! জলদি পালাও!
ভারি পায়ের শব্দ ছুটে গেল ঘরের অন্য প্রান্তে।
চিৎকার করতে করতে গোয়েন্দারাও নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। বাইরে বেরোনোর সিঁড়িটা বেয়ে আবার উঠতে লাগল। বেরিয়ে এল সেলারের মুখে।
ওরাও বেরোল, এমন সময় জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল দুটো ছায়ামূর্তি। নদীর দিকে দৌড় দিল।
ধরো ব্যাটাদের! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
ভূতের ভয়ের নামমাত্রও নেই আর মুসার মধ্যে। ছুটল লোকগুলোর পেছনে। তবে বনের ভেতরের পথ তার অচেনা, লোকগুলোর চেনা। ফলে গাছপালার আড়ালে ছোটার সময় ওরা সুবিধে বেশি পেল। পিছিয়ে পড়তে লাগল সে।
রবিনকে নিয়ে কিশোর ছুটল সোজা নদীর দিকে। বোটটেটি থাকলে সেটা আটকানোর ইচ্ছে। বন থেকে বেরিয়ে এসে দেখল পানির ধারে বাধা রয়েছে একটা মোটর বোট।
এখনও বেরোয়নি ওরা, কিশোর বলল। নেমে গিয়ে…
তার কথা শেষ হলো না। পেছন থেকে থাবা পড়ল হাতে। টর্চটী উড়ে গিয়ে পড়ল মাটিতে, নিভে গেল। বাল্ক ভেঙে গেছে বোধহয়। বাধা দেয়ার সুযোগ পেল না ওরা। কানের কাছে চেপে ধরা হলো পিস্তল। হাত-পা বেঁধে। মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হলো। তারপর বয়ে নিয়ে গিয়ে তোলা হলো বোটে।
ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উঠল কে যেন। গর্জে উঠল ইঞ্জিন।
চলতে শুরু করল বোট।
মুখ ঘুরিয়ে কিশোর আর রবিন দেখল, ডানে কালো তীরের সঙ্গে ওদের দূরত্ব বাড়ছে। বুঝতে পারল উজানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওদের। দুজন লোক রয়েছে কাছাকাছি। এরাই ওদের ধরেছে। একজন লম্বা। অন্যজন বেটে, গাট্টাগোট্টা। হাল ধরেছে সে।
এদের নিয়ে গিয়ে কি করব? সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করল লম্বা লোকটা।
দেব পানিতে ফেলে।
.
১৬.
হাত-পা বেঁধে বোটের তলায় ফেলে রাখা হয়েছে দুজনকে। অন্ধকার নদী ধরে যেন যুগ যুগ ধরে ছুটছে ওরা। রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ায় অবশ হয়ে গেছে হাতের আঙুল। বোটের মাঝামাঝি অংশে একটা সীটে বসে ওদের পাহারা দিচ্ছে লম্বা লোকটা। তর্ক করছে বেটে সঙ্গীর সঙ্গে।
পানিতে ফেললে কি ঘটবে আন্দাজ করতে পারো? লম্বু বলল। কিডন্যাপ করাটাই বিরাট অপরাধ, ভিক, তারপর খুন…
থামো, ভীতু কোথাকার! খেঁকিয়ে উঠল বাটুল। ব্রুনো, তোমার যে কবুতরের কলজে, জানতাম না। এখানেই কোথাও ডোবাব ওদের। দেখি, নোঙরটা বের করো। ওটাতে বেঁধে ছেড়ে দেব।
শীতল শিহরণ বয়ে গেল রবিনের শিরদাঁড়া বেয়ে। লোকগুলো যে এতখানি সিরিয়াস, ভাবতে পারেনি এতক্ষণ। ভেবেছে কথার কথা বলছে। এখন দেখছে সত্যি সত্যি। তার মাথাটা রয়েছে বোটের একপাশ আর সীটের মাঝখানে। মুখ থেকে কাপড়টা ফেলার জন্যে বোটের গায়ে ঘষতে শুরু করল
দেখো, আমি এ সবের মধ্যে নেই! ব্রুনো বলল।
তাহলে বসে থাকো, ভিক বলল। আমিই যা করার করব।
ইঞ্জিন নিউট্রাল করে বোট থামিয়ে দিয়ে উঠে এল বাঁটুল।
ইতিমধ্যে কাপড় খুলে ফেলেছে রবিন। আরেকটা ভারি ইঞ্জিনের শব্দ। কানে আসছে তার। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও, পিস্তলের ভয় আর করল না। মরিয়া হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল, বাঁচাও! বাঁচাও!
লাফ দিয়ে তাকে থামাতে এগোল ব্রুনো।
জ্বলে উঠল সার্চলাইট। ছুটে আসতে লাগল একটা লঞ্চ। সাইরেন বেজে উঠল। বোটের ওপর এসে পড়ল তীব্র আলো।
রবিনকে ধরা বাদ দিয়ে লাফিয়ে গিয়ে আবার হালের কাছে বসে পড়ল। ভিক। ছুটতে শুরু করল বোট।
এ সব করে বাঁচতে পারবে না, চিৎকার করে বলল রবিন। ভয় পাচ্ছে, ওদেরকে পানিতে ফেলে দিয়ে না পেছনের লঞ্চটীকে ঠেকানোর চেষ্টা করে। ডাকাতগুলো। ওদের ফেলতে দেখলে নিশ্চয় থেমে যাবে লঞ্চ, খোঁজাখুজি। করবে। এই সুযোগে পালাবে দুই ডাকাত। তবু হাল ছাড়ল না সে। বলল, নদীটা নিশ্চয় চেনেন না। একটু পর পরই পুলিশের ঘাঁটি আছে। ধরা আপনাদের পড়তেই হবে।
জবাবে গতি আরও বাড়িয়ে দিল ভিক। স্পটলাইটের আলো থেকে বাঁচার জন্যে শাই করে একবার এদিকে হাল ঘোরাচ্ছে, একবার ওদিক। বার বার মোড় নিতে গিয়ে ভীষণ দুলতে আরম্ভ করেছে বোট।
আরে করছ কি! আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল লম্বু বুকে ডুবিয়ে মারবে
ওর তো এই অভ্যাস আছেই, মোহনার কাছে আরেকটা বোটকে ডুবানোর কথা মনে পড়তে বলল রবিন। ভয় দেখানোর চেষ্টা করল, এই নদীর কোন কিছুই চেনেন না। নিচে যে কি মারাত্মক সব ডুবো পাথর আছে, জানেন না। তার ওপর অন্ধকার। সেবার তো তীরের কাছে ডুবেছিল বলে সাঁতরে উঠে জান বাঁচিয়েছেন। এবার রয়েছেন গভীর নদীতে। ডুবলে আর বাঁচতে পারবেন না।
তার সূরে সুর মিলিয়ে ব্রুনো বলল, ও ঠিকই বলেছে, ভিক, থামো তুমি! মরার চেয়ে পুলিশের হাতে পড়া ভাল!