ততক্ষণে সীটিং রুমের দেয়াল মাপতে আরম্ভ করেছে কিশোর। তারপর হলঘরে ঢুকে সেটার দেয়ালও মাপল।
ব্যাপারটা কি? কি করছ? জানতে চাইলেন ব্যাংকার।
দেখলাম গুপ্তঘরের দেয়ালে কোন কারসাজি আছে কিনা। এ সব পুরানো আমলের বাড়িতে অনেক সময় ফলস ওয়াল তৈরি করা হয়, আনমনে বলল কিশোর। কিন্তু এটার দেয়াল ফলস বলে মনে হয় না। মাপ ঠিক, কোন গণ্ডগোল নেই।
তাজ্জব ব্যাপার! রবিন বলল। হুমকিটীকে সিরিয়াসলি নেবেন, মিস্টার ককার। সাবধানে থাকবেন।
চওড়া সিঁড়িটা বেয়ে নিচে নেমে এল তিনজনে।
নীরব বাড়িটাতে একটাই মাত্র শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন। বিরাট ঘড়িটার শব্দ:
টিক-টক! টিক-টক! টিক-টক!
বিড়বিড় করল রবিন, ঘড়ি যখন টিক টিক করবে, তখন আসবে মরণ!
লিভিং রুমের দিকে এগোল সে। গ্র্যাণ্ড ফাদার কুকটার সামনে দাঁড়াল। একতালে দুলছে পেণ্ডুলাম। শব্দ করছে টিক-টক, টিক-টক।
কপাল ভাঁজ করে ফেললেন ককার, একবারও দম দিইনি আমি ঘড়িতে! চলে কি করে?
নিশ্চয় দেয় কেউ, রবিন বলল। কাল রাতেও দেখে গেছি চলছে। যে লোক নোট রেখে যায়, হতে পারে সে-ই চাবিও দিয়ে যায়। সে বলছে, ঘড়ি টিক টিক করলে মরণ আসবে, হয়তো এই ঘড়িটার কথাই বলেছে।
ঘড়ির নিচে পেণ্ডুলাম রয়েছে যে খুপড়িটায়, তার কাচের দরজাটার দিকে তাকাল সে। ভেতরে অন্য কিছু নেই। ওপরের দরজাটী সাবধানে খুলে। ভেতরটা দেখল।
এখানেও কিছু নেই।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। গভীর চিন্তায় মগ্ন। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছে। বলল, মিস্টার ককার, আমাদের ডুপ্লিকেট চাবির খবর
হায় হায়, তাই তো! এত কাজের চাপ, চাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক আছে, কাল সকালে আগে চাবিওয়ালার কাছে যাব, তারপর অন্য কাজ।
.
০৯.
ইয়ার্ডে ফিরে মুসার পুরানো জেলপি গাড়িটাকে চতুরে দাঁড়ানো দেখল ওরা। মুসা বসে আছে ওঅর্কশপে। ওদের অপেক্ষায়।
তদন্তের কতখানি অগ্রগতি হয়েছে, কিছুই জানে না সে। শুনতে চাইল।
সব তাকে খুলে বলতে লাগল রবিন আর কিশোর। বদ্ধ ঘরে নোট পাওয়া গেছে শুনে গম্ভীর হয়ে গেল মুসা। মাথা দুলিয়ে বলল, বুঝলাম!
কি বুঝলে? ভুরু কোঁচকাল রবিন।
কে ওখানে নোট ফেলে এসেছে।
কে? রবিন অবাক।
ভূতে। বদ্ধ ঘরে ঢুকতেও কোন অসুবিধে হয় না ওদের।
তোমার মাথা! ভূত না ছাই! মানুষই ঢুকেছে। কি ভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না!
সেটা বুঝতে হলে বাড়িটার ওপর নজর রাখতে হবে আমাদের। ভাবছি, আজ রাতেই আবার যাব। কেউ ঢোকে কিনা দেখব। ঢুকলে তাকে ধরার চেষ্টা করব। মুসা, বাড়িতে তোমার কাজ শেষ হয়েছে?
পুরোপুরি হয়নি। তবে আজ রাতে না করলেও চলবে।
তাহলে যেতে পারবে আমাদের সঙ্গে?
পারব।
ভূত আছে তো পোড়োবাড়িতে, হেসে বলল রবিন, ভয় লাগবে না? যদি চেপে ধরে?
দোয়া-দরূদ পড়তে পড়তে যাব, হাত নেড়ে মুসা বলল, তাহলেই আর কাছে ভিড়তে পারবে না ভূত।
রাত নামার অপেক্ষা করল ওরা। তারপর তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনলে পালিয়ে যেতে পারে চোরেরা, তাই গাড়ি নিল না। হেঁটে চলল। টর্চ আছে সঙ্গে, জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ল না। চমৎকার চাঁদের আলো।
শহর ছেড়ে এসে নদীর পাড়ের পথ ধরল। এ পথে যানবাহন খুব কম। দুএকটা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। রিভেরা এস্টেটের দিকে কোন গাড়ি যেতে দেখলেই পথের পাশের পপি কিংবা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে ওরা। বলা যায় না, গাড়িটা চোরেরও হতে পারে। চিনে ফেলতে পারে ওদের।
রিভেরা হাউসের গেটে এসে ফিরে তাকাল মুসা। কেউ পিছু নিয়েছে। কিনা দেখল। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয় রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। নির্জন। গেটের পাশে গাছের জটলা আর দেয়ালে লম্বা লম্বা আইভি লতা রহস্যময় ছায়া সৃষ্টি করেছে। নিজের অজান্তেই গায়ে কাটা দিল তার।
গেট বন্ধ। ডিঙাতে অসুবিধে হলো না। ভেতরে ঢুকে বাড়িটার কাছাকাছি। এসে ঝোপে লুকিয়ে বসল। এখান থেকে সামনে-পেছনে দুদিকের দরজার ওপরই নজর রাখা যায়। চাঁদের আলোয় চকচক করছে বাড়ির প্লেট পাথরের টালি।
বসে আছে তো আছেই ওরা। কেউ আর আসে না। উসখুস শুরু করল মুসা। উঠে চলে যাওয়ার কথা বলতে যাবে কিশোরকে এই সময় তার গায়ে। কনুইয়ের তো মেরে ফিসফিস করে রবিন বলল, ওই দেখো!
জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে সাদা শার্ট পরা খাটেীমত এক লোক। বাড়িটার দিকে এগোল। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় পথ ওর চেনা।
ধরতে হবে, কিশোর বলল। এসো।
নিঃশব্দে এগোল ওরা। আরেকটু হলেই পেছন থেকে গিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু গোলমাল করে ফেলল মুসা। শুকনো ডালে পা। দিয়ে বসল। মট করে ভাঙল ওটা।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। তিন গোয়েন্দাকে দেখে একটা মুহূর্ত দেরি করল না। নদীর দিকে দৌড় দিল।
পিছু নিল তিন গোয়েন্দা।
সাংঘাতিক দৌড়াতে পারে লোকটা। বনের মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের পলকে।
ওর কাছে পিস্তল থাকতে পারে এই ভয়ে টর্চ জ্বালতে সাহস করল না গোয়েন্দারা। চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও বনের মধ্যেটা অন্ধকার। দেখা গেল না লোকটাকে।
খানিক পর একটা মোটর বোটের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। নীরব রাতে অনেক বেশি করে কানে বাজল শব্দটী। নদীর দিকে ছুটল ওরা।
দেরি করে ফেলেছে। নদীর পাড়ে এসে দেখল, চলতে আরম্ভ করেছে। ছোট একটা স্পীড বোট। হুইল ধরে বসেছে লোকটা।