আরেকবার লাফ দিয়ে আরও পিছিয়ে এল কিশোর। মূসা আর রবিন দাঁড়িয়ে গেছে। তাকিয়ে আছে গিরগিটিটার দিকে। চামড়ার রঙ কালচে বেগুনী। তাতে হলুদ রঙের গোল গোল ছাপ। সারা শরীরে অসংখ্য আঁচিলের মত জিনিস কুৎসিত করে তুলেছে প্রাণীটাকে।
খাইছে! ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ। কি এটা? কুমিরের বাচ্চার ব্যারাম হয়েছে?
হিলা মনস্টার, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। জোরে দৌড়াতে পারে না বটে, তবে দাঁতের নাগালে পেলে সর্বনাশ করে দেবে। সাংঘাতিক বিষাক্ত।
থেমে গেল গিরগিটিটা। ঠাণ্ডা, কুৎসিত চোখ মেলে দেখছে গোয়েন্দাদেরকে।
আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, হেসে বলল রবিন।
সার্থক হয়েছে তার চেষ্টা, মুসা বলল। ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেছে। আমার। এমন ভূতুড়ে জানোয়ার জনমেও দেখিনি। দাঁড়িয়ে থাকব কতক্ষণ। নড়লেই তো মনে হচ্ছে নড়ে উঠবে!
উঠুক। না দেখে গায়ে পা দিয়ে ফেললে বিপদ, কামড়ে দিতে পারে, কিশোর বলল। দেখে যখন ফেলেছি, আর কিছু করতে পারবে না। দৌড়ে পারবে না আমাদের সঙ্গে। তবে সাবধান যে করে দিয়েছে, এ জন্যে একটা ধন্যবাদ ওর পাওনা। ওর জাতভাইরা আরও অনেক আছে এই অঞ্চলে। বালি আর ঝোপের মধ্যে চুপ করে পড়ে থাকলে চোখে পড়বে না। ভুল করে পা দিয়ে ফেললেই মরব। সুতরাং, সাবধান!
কয়েক মিনিট একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ফোঁস ফোঁস করল হিলা মনস্টার। বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে ঘুরল। অলস ভঙ্গিতে হেলেদুলে আস্তে আস্তে গিয়ে ঢুকে পড়ল একটা ঝোপে।
আবার পা বাড়াল তিন গোয়েন্দী। এগিয়ে চলল চকচকে জিনিসটার দিকে। হাঁটছেই, হাঁটছেই, কিন্তু জিনিসটার কাছে পৌঁছতে পারার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না। আশ্চর্য!
পায়ে মোকাসিন পরেছে ওরা। তলা ফুড়ে যেন উঠে আসছে তপ্ত বালির ভয়ানক উত্তাপ।
রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে মুসা বলল, বাপরে বাপ, হিলা মনস্টারের বাচ্চা এই বালিতে হাঁটে কি করে! পায়ে কিসের চামড়া লাগানো!
কিসের আর, ওরই চামড়া, কিশোর বলল। গরম বালিতে চলার উপযোগী করেই বানিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি।
কিন্তু ওই চকচকে জিনিসটা কাছে আসে না কেন? ভূতুড়ে কাণ্ড মনে হচ্ছে!
ভূতটা আসলে বাতাস। বেশি হালকা বলে এখানে অনেক দূরের জিনিসও কাছে মনে হয়।
অবশেষে পৌঁছল ওরা ওটার কাছে। গোল একটা জিনিস রোদে পড়ে চমকাচ্ছে।
তুলে নিল রবিন। বড় একটা পাথর, তাতে ছোট ছোট অন্য পাথর গাঁথা। কোনটী গাঢ় লাল, কোনটা বাদামী, কিছু আছে সবুজ। নাড়াচাড়ায় গায়ে রোদ পড়লেই ঝিক করে উঠছে পাথরগুলো।
কিশোরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে, কি এটা, বলো তো? কোন ধরনের স্ফটিকের সমষ্টি?
সম্ভবত জ্যাসপার।
মুসা জানতে চাইল, দামী জিনিস? হীরার মত?
হীরার মত অত দাম না হলেও, দামী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আশেপাশে খুঁজল ওরা। ওরকম পাথর আর একটাও পাওয়া গেল না।
অবাক কাণ্ড! রবিন বলল। এটী এখানে এল কোত্থেকে?
মাটির দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে নিজেকেই প্রশ্ন করল, এর সঙ্গে লফারের নিখোঁজের কোন সম্পর্ক নেই তো?
বুঝতে পারল না মুসা। মানে?
এখানে জন্মালে এ রকম পাথর আশেপাশে আরও থাকার কথা। নেই কেন?
হয়তো ছিল, রবিন বলল। আকাশ থেকে চোখে পড়েছে লফার আর ব্রাউনের। এগুলোর জন্যেই নেমেছিল ওরা। তুলে নিয়েছিল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঠিক এই কথাটাই বলতে চাচ্ছি আমি। সবই নিয়ে গেছে, কিন্তু এই একটা কোনভাবে রয়ে গেছে এখানে। হয়তো কাড়াকাড়ির সময় পড়ে গেছে। সেজন্যেই লফার আর ব্রাউন নিখোঁজ।
অস্বস্তি ফুটল মুসার চোখে। কিশোরের কথা এতক্ষণে বুঝেছে। আচ্ছা, বুঝলাম! ওদেরকে খুন করে পাথরগুলো ডাকাতেরা কেড়ে নিয়ে গেছে সন্দেহ করছ! মরুভূমিতে লাশ গুম করে ফেলেছে।
করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, রবিন বলল। দামী পাথরের জন্যে মানুষ খুন হওয়াটা নতুন কিছু নয়।
উফ, কি রোদরে বাবা! সিদ্ধ হয়ে গেলাম! মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল কিশোর। এখানে আর দেখার কিছু নেই। চলো, প্লেনে গিয়ে বসি।
প্লেনের দিকে হাঁটতে লাগল ওরা। মনে হচ্ছে কাছে, অথচ যতই হাঁটে, পথ আর ফুরায় না।
ভারী পাথরটা নিয়ে হাঁটতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে গেল রবিন। তা দেখে মুসা বলল, দেখি, দাও আমার কাছে।
পাথরটা মুসার হাতে তুলে দিয়ে বাঁচল রবিন।
কিছুদূর এগিয়ে মুসারও হাঁপ ধরে গেল। বলল, খাইছে! এটী পাথর না লোহারে বাবা! দশ টন ওজন হবে!
তার কথা শেষ হতে না হতেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ওই দেখো, হিলা মনস্টার!
কই, কোথায়! এতটাই চমকে গেল মুসা, হাত থেকে ছুটে উড়ে গিয়ে পড়ল পাথরটা। লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ল সে।
তবে অত চমকানোর কিছু ছিল না। বেশ দূরে রয়েছে গিরগিটিটা। ওদের দিকে তাকাল না। ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ঢুকল একটা ঝোপের মধ্যে।
কিন্তু পাথরটা আর দেখতে পেল না ওরা। গেল কোথায়?
ওটাতে পড়ল না তো? একটা গর্ত দেখিয়ে বলল রবিন।
গর্ত না বলে সরু একটা ফাটল বলা উচিত। বেশ গভীর। দেখা গেল, তার মধ্যেই পড়েছে পাথরটা। তুলতে কষ্টই হলো। সাবধান থাকতে হলো হিলা মনস্টারের ব্যাপারে। গর্তে থাকলে কামড়ে দিতে পারে। আর কামড়ালে মরতে হবে।
মুসা কিছুক্ষণ বহন করার পর পাথরটার ভার নিল কিশোর। ভাগাভাগি করে বয়ে এনে প্লেনে তোলা হলো ওটাকে।