সেদিন আর মরুভূমিতে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না গোয়েন্দাদের। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে একটা হোটেলে উঠল।
পরদিন সকালে এল আবার। বিমান বন্দরের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কাটা নিয়ে সেই পাইলট ফিরে আসেনি।
মরুভূমির উদ্দেশে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।
এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া কলোরাডো নদীর রূপালী পানি চোখে পড়তে কিশোর বলল, মুসা, নিচে নামাও। ভালমত নজর রাখতে হবে। তার কোলের ওপর ক্যালিফোর্নিয়া, মরুভূমি আর অ্যারিজোনার তরাই অঞ্চলের একটা ম্যাপ বিছানো।
ওই দেখো! ডানে হাত তুলে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। একটা দানব!
দেখা গেল একশো ফুট খাড়া উঠে যাওয়া একটা পাহাড়ের দেয়ালের কিনারে আঁকা হয়েছে বিশাল ছবিটা। দেয়ালের কাছে প্লেন নিয়ে গেল মুসা। চক্কর দিতে লাগল একজায়গায়। বলল, আরেকটা পা কি হলো দানবের? ভূতে খেয়ে ফেলল নাকি?
ক্ষয় হয়ে গেছে কোন কারণে, বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। ওটার পাশে দেখো আরেকটা ছোট মূর্তি। আশপাশের ওই রেখাগুলো কি?
বড় ছবিটার পাশে ওটার অর্ধেক বড় আরেকটী ছবি। রেখাগুলো তার বড় ভাইয়ের চেয়ে অনেক গভীর করে কাটা হয়েছে। তাই মুছেও যায়নি, ফুটেও উঠেছে অনেক স্পষ্ট হয়ে।
মাঝের ডিজাইনটা ক্রসের মত লাগছে, রবিন বলল।
একে বলে মালটিজ ক্রস, রেফারেন্স বইতে এ ধরনের রেখাচিত্রের ছবি দেখেছে কিশোর। পুরানো ইউরোপিয়ান ডিজাইন। নাইটস অভ মালটা নামে। একটা ক্রসেডর গ্রুপের স্মারকচিহ্ন এটা।
কিন্তু ইনডিয়ানরা নাকি এঁকেছে এই ছবি? প্রশ্ন করল মুসা।
সেটাও একটা ধারণা মাত্র, জবাব দিল রবিন। ইতিমধ্যে এই নকশী নিয়ে বেশ কিছু অধ্যায় পড়ে ফেলেছে সে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এই চিহ্ন প্রমাণ করে প্রাচীন স্প্যানিশ ভ্রমণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল ইনডিয়ানদের। আসলে, কেউই ঠিক করে বলতে পারে না কারা একেছিল এই ডিজাইন, কেন এঁকেছিল। এরিক ফন দানিকেন নামে একজন সুইস পুরাতাত্ত্বিকের বিশ্বাস, মহাকাশ থেকে নেমে আসা ভিনগ্রহবাসীর এঁকেছে এই ছবি। কিংবা তাদের নির্দেশে ইনডিয়ানরা এঁকেছে। স্পেশশিপ নিয়ে নামার সময় এই চিহ্ন দেখে বুঝতে পারত প্রাচীন সেই ভিনগ্রহবাসীরা, কোথায় নামতে হবে। যেহেতু আকাশ থেকে আগুনের রথে চেপে নামত ওরা, ইনডিয়ানরা ভাবত দেবতা।
তারমানে ভূতের কথাটা একেবারে মিথ্যে বলিনি! কেঁপে উঠল মুসার গলা। আমার তো ধারণা ভূতে গাপ করে দিয়েছে লফার আর তার বন্ধুকে!
তোমার মাথা! অধৈর্য স্বরে বলল কিশেয়। যত্তসব অবাস্তব ধারণা!
নদীর এ পাড়ে আর কোন ছবি দেখা গেল না। অন্য পাড়ে প্লেন নিয়ে এল। মুসা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখে পড়ল আরেকটা দানব। আরও এগোতে বোঝা গেল, একটা দানবীয় কুকুরের ছবি আঁকা হয়েছে।
এখানেই প্লেন নামিয়েছিল লফার, কিশোর বলল।
আশ্চর্য! দেখতে দেখতে বলল রবিন। এত নিখুঁত, দানিকেনের কথাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে! মাটিতে দাঁড়িয়ে এই জিনিসের আকৃতি বুঝল কি করে শিল্পী? একমাত্র আকাশ থেকে দেখেই বোঝা সম্ভব!
খানিকটা এগিয়ে আরেকটা মানুষাকৃতির দানব আর ঘোড়ার ছবি দেখা গেল।
অনেকক্ষণ দেখেটেখে কিশোর বল, এবার ফিরে যাওয়া যায়।
ম্যাপে দেখা গেল, কাছাকাছি বিমান বন্দর রয়েছে রিভারসাইড কাউন্টিতে। সেখানে নেমে গাড়িতে করে ব্লাইদিতে যেতে হবে।
বিমান বন্দরের ওপরে এসে রেডিওতে নামার অনুমতি চাইল মুসা। অনুমতি পাওয়া গেল। নিখুঁত ভাবে ল্যাণ্ড করল সে। ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে গেল হ্যাঁঙ্গারের দিকে। আগের দিনের মত কোন অঘটন ঘটল না।
প্লেন থেকে নেমে এসে একটা কেবিনে ঢুকল গোয়েন্দারা। চেয়ারে বসে হতি-পা ছড়িয়ে আরাম করছে, এই সময় এগিয়ে এল রুক্ষ চেহারার ছিপছিপে এক লোক। নিজেকে ফেডারেল অ্যাভিয়েশন এজেন্সির লোক বলে পরিচয় দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমাদের মধ্যে পাইলট কে? কে প্লেনটা চালাচ্ছিলে?
অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। মুসা জবাব দিল, আমি। কেন?
লাইসেন্স দেখি?
বের করে দিল মুসা।
লাইসেন্সটা খুঁটিয়ে দেখল লোকটা। কোন খুঁত পেল বলে মনে হলো না। মাথা দুলিয়ে বলল, হু, তোমাকেই খুঁজছি। আচমকা কর্কশ হয়ে গেল কণ্ঠস্বর, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে!
.
০৩.
ব্যাপার কি বলুন তো? জানতে চাইল রবিন।
জবাব দিল না বোকটী! মাথা নেড়ে মুসাকে তার সঙ্গে যেতে ইশারা করল। মুসা উঠছে না দেখে তার হাত চেপে ধরে টান দিল।
তাকে প্রায় টেনে নিয়ে চলল, লোকটা। রবিনকে মালপত্রের পাহারায় বসিয়ে রেখে পিছে পিছে চলল কিশোর।
কেবিন থেকে দূরে ছোট একটা বিল্ডিঙের একটা অফিস ঘরে মুসাকে নিয়ে এল লোকটা। কিশোরও ঢুকল সঙ্গে। ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন। গোলগাল চেহারার এক ভদ্রলোক। একটা টাইপরাইটার নিয়ে যেন কুস্তি করছেন। রোলারের এ মাথার নব ধরে একবার টানছেন, ওমাথার নব ধরে একবার। নড়াতেও পারছেন না, সরাতেও পারছেন না।
হেসে এগিয়ে গেল কিশোর। বলল, মনে হয় এ জিনিস আর ব্যবহার করেননি? দিন, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
একটা লিভার টিপল সে। ফ্রী হয়ে গেল রোলার। সরাতে আর অসুবিধে হলো না।
বাহ, এত সহজ? ভারি গলায় বললেন ভদ্রলোক। থ্যাংক ইউ। মুসার দিকে তাকিয়ে ছিপছিপে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ও কে?
স্যার, সেই প্লেনটার পাইলট। স্যান বারনাডিনোতে অ্যাক্সিডেন্ট করছিল। আরেকটু হলেই।