খসখস শব্দ হলো পেছনে। ফিরে তাকাতে গেল সে। মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। চোখের সামনে জ্বলে উঠল হাজার কয়েক রঙবেরঙের তারী।
ঢলে পড়ে গেল মুসা।
.
০২.
ওঅর্কশপে আলো নেই দেখে কিশোর আর রবিনও অবাক হয়েছে। ভাবল, কোন কারণে নিভিয়ে দিয়েছে মুসা। স্মিথ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর গেট লাগিয়ে দিল কিশোর। রবিনকে নিয়ে এগোল ওঅর্কশপের দিকে।
মাটিতে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা মুসার গায়ে হোঁচট খেল কিশোর। চিৎকার করে উঠল, মুসা, কি হয়েছে তোমার?– মুসার ভারি দেহটা ধরাধরি করে বসার ঘরে নিয়ে এল সে আর রবিন। লম্বা সোফায় শুইয়ে দিল।
ইয়ার্ডের বেচাকেনার হিসেব নিয়ে বসেছিলেন মেরিচাচী, চেঁচামেচি শুনে। নেমে এলেন। বেহুশ মুসাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে?
কিশোর বলল, কেউ বাড়ি মেরে বেহুশ করে ফেলে রেখে গেছে!
মরবি! এ ভাবেই মরবি তোর একদিন! বলে ছুট দিলেন চাচী। ভেজা তোয়ালে আর স্পিরিট অভ অ্যামোনিয়া নিয়ে এলেন। ততক্ষণে মুসার শার্টের বোতাম, কোমরের বেল্ট খুলে কাপড়-চোপড় ঢিল করে দিয়েছে কিশোর আর রবিন।
তুলোয় স্পিরিট অভ অ্যামোনিয়া ভিজিয়ে মুসার নাকের কাছে ধরলেন। মেরিচাচী। ভেজা তোয়ালে দিয়ে হাত-পায়ের তালু মুছে দিতে লাগল রবিন।
ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে ঢুকতে গুঙিয়ে উঠল মুসা।
কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল কিশোর, মুসা, ওঠো! তাকাও! এই মুসা, শুনতে পাচ্ছ? তোমার চকলেট-কেক শেষ হয়ে গেল তো!
চোখ মেলল মুস, চকলেট-কেকের কথা বললে শুনলাম?
হাসি ফুটল মেরিচাচীর ঠোঁটে। হ্যাঁ, ওঠো। আস্তটাই রেখে দিয়েছি তোমার জন্যে।
কি ঘটেছিল, জানার জন্যে প্রশ্নের তুবড়ি ছোটাল কিশোর আর রবিন।
কে যে বাড়ি মারল, কিছুই বলতে পারব না, দুর্বল কণ্ঠে জানাল মুসা। অন্ধকারে দেখতে পাইনি।
তার জন্যে গরম দুধ আনতে চলে গেলেন মেরিচাচী।
কিন্তু বাড়িটা মারল কে? কেন মারল? রবিনের প্রশ্ন।
আন্দাজ করতে পারছি, মুসা বলল। একটা সাংঘাতিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। ছবি!
ছবি! দুই ভুরু কুঁচকে কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের।
উঠে বসল মুসা। মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ। দুটো ছবি তুলেছি। প্রথম ছবিটা যার তাকে চিনি না। মনে হলো ভুল করে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পেরে বেরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় ছবিটা মিস্টার স্মিথের। তাকে দেখে অবাক হতাম না, হয়েছি তাঁর পেছনে আরেকজনকে দেখে। জঞ্জালের ওপাশে ঘাপটি মেরে ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চেহারা। ছবি দেখেই বোঝা যায় লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে। এই লোকটাকেও চিনি না।
ছবিগুলো কোথায়! অধীর হয়ে জানতে চাইল কিশোর।
বেহুশ হওয়ার আগে পর্যন্ত তো হাতেই ছিল। হয়তো পড়ে গেছে। ওঅর্কশপের দরজায় খুঁজলে পাওয়া যাবে।
কিন্তু পাওয়া গেল না ছবিগুলো।
ওঅর্কশপের দরজায় একটুকরো কাগজ টেপ দিয়ে সটা। তাতে লেখা:
তিন গোয়েন্দা, সাবধান লেখার
নিচে আঁকা একটা রেখাচিত্র। ছবিতে একটা লোক, তার বুকের দিকে তীর তাক করা।
আঁকিয়ে হিসেবে সুবিধের না, রবিন বলল। কিশোর, কি বোঝাতে চেয়েছে?
বোঝাতে চেয়েছে, আমরা যেন সরে থাকি। নাহলে হৃৎপিণ্ড বরাবর তীর মারবে। তুড়ি বাজাল কিশোর, অর্থাৎ, খতম করে দেবে!
নেগেটিভগুলোর জন্যে ল্যাবরেটরিতে ঢুকল ওরা। ছবি ডেভেলপ করার জায়গাটায় জিনিসপত্র উলট-পালট হয়ে আছে। কেউ যে খুঁজে গেছে, বোঝা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে; ছবি, নিগেটিভ, কিছুই না পেয়ে খালিহাতে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। জানাল কি ঘটেছে।
সব শুনে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল মুসা, কেবল নিজেকেই বড় গোয়েন্দা ভাব, তাই না? হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল নেগেটিভগুলো মূল্যবান, কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার।
অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল কিশোর, কোথায় রেখেছ?
উঠে দাঁড়াল মুসা। ঘুরে উঠল মাথা। আবার বসে পড়ল সে। খানিকক্ষণ পর একটু সুস্থ হয়ে কিশোর আর রবিনের সঙ্গে চলল ল্যাবরেটরিতে।
একটা উঁচু টুলের নিচে হাত ঢুকিয়ে নেগেটিভ দুটো বের করে আনল। টেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল ওখানে।
ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ওগুলো নিয়ে ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেল রবিন। ছবি প্রিন্ট করতে দেরি হলো না। বেরিয়ে এল ভেজা ছবি হাতে। টেবিলে রাখল।
ছবির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। প্রথম যে লোকটার ছবি তোলা, হয়েছে, তার ছিপছিপে শরীর, মাথায় ধূসর চুল। আর স্মিথের পেছনে যে লোকটার ছবি উঠেছে, তার কালো চুল, পেশীবহুল দেহ।
তখুনি ফোন করে সাইমনকে সব কথা জানাল কিশোর। তার পরামর্শ চাইল।
পরদিন সকালে ছবিগুলো নিয়ে রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে চলল তিন গোয়েন্দা। অফিসেই পাওয়া গেল পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে। প্রথম ছবিটার ওপর টোকা দিয়ে গভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, চিনি এঁকে। নাম মরিস ডুবয়। রকি বীচ সেভিংস ব্যাংকের ট্রাস্টি। ভদ্রলোক, তবে বড় বেশি খামখেয়ালি। পথ চলতে চলতে প্রায়ই নিজের বাড়ি ভেবে ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। অনেকে রিপোর্ট করেছে পুলিশের কাছে। দ্বিতীয় ছবিটীয় টোকা দিয়ে বললেন, এর ব্যাপারে ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারছি না।
কিন্তু অপরাধীদের রেকর্ড ফাইলে পাওয়া গেল না লোকটার নাম।
ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা। স্মিথের অফিসে। তার সঙ্গে দেখা করতে চলল।