কিশোরের কাঁধে হাত রেখে আলতো চাপ দিল রবিন। নীরবে হাত তুলে দেখাল। তারার আলোতেও ঝোপের পাশের গুহামুখটা নজরে পড়ছে। আগের বার দিনের বেলা কেন নজরে পড়েনি বুঝতে অসুবিধে হলো না। মুখের অর্ধেকটা ঝোপের আড়ালে থাকে। বাকি অর্ধেকটীয় পাথর চাপা দিয়ে রাখলে সহজে কারও চোখে পড়বে না। চোরাই মাল কিংবা জাল চেক লুকিয়ে রাখার চমৎকার জায়গী।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা প্লেনের ইঞ্জিনের গুঞ্জন শোনা গেল।
একসঙ্গে জ্বলে উঠল অনেকগুলো আলো। আচমকা আলোকিত করে ফেলা হলো চুড়ার একাংশ। বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বেলে দানবীয় নকশাটার বাঁ হাতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে চারজন লোক। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। একজনকে চিনতে পারল কিশোর–ডগলাস বর্ড, অন্য তিনজন অপরিচিত। না না, আরও একজনকে চেনা গেল। সবুজ মোটরবোট চুরি করেছিল যে লোকটা, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল, এ সেই লোক।
উড়ে এল প্লেনটী। একটা আলোও জ্বালেনি। টিলার মাথায় চক্কর দিল দু বার। কালো আকাশের পটভূমিতে ভালমতই চোখে পড়ছে ওটাকে। হঠাৎ সাদাটে একখণ্ড ধোঁয়ার মত কি যেন ছিটকে বেরোল ওটা থেকে।
চিনে ফেলল কিশোর। প্যারাশুট!
সরে যেতে লাগল প্লেনটা। তারমানে ওটার কাজ শেষ, চলে যাচ্ছে এখন
নেমে আসছে প্যারাশুট। কোন মানুষ নেই। দড়িতে বাধা বড় প্যাকেটের মত একটা জিনিস ঝুলছে। দানবের গায়ের ওপর নামল ওটা। দোল খেয়ে বিশাল এক ছাতার মত ধসে পড়ল প্যারাশুটটা। ঘিরে ফেলল চার লণ্ঠনধারী। আলো নিভিয়ে ফেলেছে। প্যারাশুট থেকে প্যাকেটটা খুলতে ব্যস্ত হলো। আক্রমণ করার এটাই উপযুক্ত সুযোগ।
রবিনকে নিয়ে উঠে দৌড় দিল কিশোর। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, আরও চারটে ছায়ামূর্তি বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসছে।
এ রকম কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরি ছিল না ডাকাতেরা। চমকে গেল। ওরা আঘাত হানার আগেই ওদের ওপর এসে পড়ল আঘাত। পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ পেল না তেমন। যোদ্ধা হিসেবেও ওরা ভাল না। কারাত জানা চার গোয়েন্দা, সেই সঙ্গে বাড়তি আরও দু-জন লোক, এতজনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। তাছাড়া সাইমনের কাছে রয়েছে পিস্তল।
কাবু করে ফেলা হলো চার ডাকাতকে।
হঠাৎ পাথর গড়ানোর শব্দ হলো। ঝট করে ঘুরে তাকাল মুসা। চোখে পড়ল দ্রুত ঢালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটা ছায়ামূর্তি। ডাকাতদের আরেকজন। ধরো, ধরো ব্যাটাকে! চিৎকার করে দৌড় দিল সে।
পালাতে পারল না লোকটা। ডাইভ দিয়ে তাকে নিয়ে মাটিতে পরল মুসা।
লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠল লফার, ব্রাউন!
হ্যাঁ, এই লোকটাই পালের গোদা, মিস্টার সাইমন বললেন। আপনার বন্ধু।
চারজনকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সে। প্লেনের দিকে নজর ছিল বলে প্রথমে আমাদের কাউকে চোখে পড়েনি। দলের চারজন লোককে আক্রান্ত হতে দেখে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। ওরা ধরা পড়ার পর পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু সর্বনাশ করে দিল পাথরটা। ওটাতে লাথি লেগে শব্দ হয়ে গিয়েছিল। দেখে ফেলেছিল মুসা।
দড়ির অভাব নেই। প্যারাশুট থেকে দড়ি কেটে নিয়ে পাঁচজনকে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। ঝোপ আর পাথরের আড়ালে খুঁজে দেখা হলো আর কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। না, আর কেউ নেই।
প্যারাশুটে করে নামিয়ে দেয়া প্যাকেটটা খুললেন সাইমন। বেরিয়ে পড়ল। নিখুঁত ভাবে বাণ্ডিল করা হাজার হাজার জাল চেক। ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্টের নামে ছাপা।
যাক, প্রমাণ সহ হাতেনাতে ধরা পড়ল, সন্তুষ্ট হয়ে বললেন সাইমন। অস্বীকার আর করতে পারবে না কিছু।
একটা টর্চ হাতে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বলল, আমার সঙ্গে আসুন। একটা জিনিস দেখাব।
ঝোপের ধারে গুহামুখটার কাছে সবাইকে নিয়ে এল সে। আলো ফেলে দেখে বোঝা গেল, গুহা নয়, বড় গর্ত। ভেতরে পাওয়া গেল দড়ির বাণ্ডিল, মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি, আর আরও এক বস্তা জাল চেক।
আঁতকে গেল মুসা। বাপরে বাপ, কত! সব বাজারে ছাড়তে পারলে সর্বনাশ হয়ে যেত!
আসল কাজ শেষ। এবার বন্দিদের নিয়ে যেতে হবে। সেটা একটা বড় সমস্যা। সমাধান দিল মুসা। সে আর বল বোট নিয়ে যাবে পুলিশকে খবর দিতে। অন্যেরা ততক্ষণ ওখানেই বসে পাহারা দেবে বন্দিদের।
মুসা আর বল চলে গেল।
লণ্ঠন জেলে বন্দিদের কাছে বসে রইল অন্য চারজন।
আমাকে পুলিশে দিলে লফারও বাঁচতে পারবে না, আচমকা পাতলা, নাকি গলায় বলে উঠল ব্রাউন। সে-ও আমাদের দলে ছিল।
না, ছিল না, জোর প্রতিবাদ করলেন সাইমন। তোমাদের ভয়ে বহুদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে।
তাতে কি? আমাদের সঙ্গে কাজ করার পর পালিয়েছে। আমার কাছ থেকে জাল চেক নিয়ে বাজারে ছেড়েছে। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
বিষণ্ণ স্বরে জবাব দিল লফার, ও ঠিক কথাই বলেছে। আদালতে দোষ স্বীকার করতে রাজি আছি আমি।
তা কেন করবেন? কিশোর বলল। আপনি তো আর ইচ্ছে করে। করেননি। প্রাণের ভয় দেখিয়ে আপনাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে।
সেটা প্রমাণ করতে পারবে না সে, খিকখিক করে হাসল ব্রাউন। তবে জাল চেক দিয়ে যে জিনিস কিনেছে আমি প্রমাণ করতে পারব। কোন কোন দোকানে চেক ভাঙিয়েছে সে, মনে আছে আমার। ওরা সাক্ষ্য দেবে, চেকগুলো ব্রাউন ওদের দিয়েছে। পুলিশ আমার কিছুই করতে পারবে না। কারণ একটা চেকও আমি নিজের হাতে ভাঙাইনি। মরলে আর সবাই মরবে। আমার কিছুই হবে না।