ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর স্টেশনে পৌঁছল গাড়িটা। লাফিয়ে নামল দু-জন লোক, আমেরিকান বলে মনে হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোন ভবঘুরেকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি কিনা। লোকটা নাকি অপরাধী। কিন্তু আমার কাছে তাকে ওরকম মনে হয়নি।
তারপর? জানতে চাইল কিশোর। বুকের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে, এতদিনে আসল খবরটা পাওয়া গেছে।
ভ্রূকুটি করল কাপারিলো। বরং ওই লোকগুলোকেই খারাপ মনে হলো আমার। অনেক দিন আমেরিকায় ছিলাম আমি। ওখানকার অপরাধী দেখেছি। কি রকম অচিরণ করে জানি। বিশ্রী ভাষায় কথা বলে, গাল দেয়। বিশালদেহী, রুক্ষ চেহারার ওই দু-জনও এ রকমই করছিল।
উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারল না রবিন। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলল যাতে কাপারিলো বুঝতে না পারে, ওই ভবঘুরেই নিশ্চয় লফার! আর লোকগুলো মনে হয় সেই দু-জন, যারা তার অফিসে গিয়ে তার সেক্রেটারিকে হুমকি দিয়েছে!
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মনে হয়।
কাপারিলোর দিকে তাকাল রবিন। জিজ্ঞেস করল, ভবঘুরে লোকটা লম্বা, না খাটো? দেখতে কেমন?
লম্বা। হালকা-পাতলা। মনে হলো অনেক পথ হেঁটে এসেছে। ভীষণ ক্লান্ত।
হু, মাথা দোলাল কিশোর। উত্তরে, সীমান্তের দিকে।
তাহলে, নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর, লফার এখনও বাড়ি পৌঁছল না কেন?
হয়তো ধরা পড়েছে, রবিন বলল। যারা তার পিছে লেগেছিল, তারা ধরে ফেলেছে। কিংবা হয়তো তার বাড়ির ওপর নজর রাখা হয়েছে ভেবে ভয়ে বাড়িতে ঢুকছে না। অথবা এমনও হতে পারে, কোন বিপদে পড়েছে তার বন্ধু ব্রাউন, তাকে উদ্ধার করার জন্যে মেকসিকোতে রয়ে গেছে সে।
এইটা হতে পারে। ব্রাউনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। নিজেদের মধ্যে। কথাগুলো বাংলায় চালিয়ে যাচ্ছে কিশোররা। কিন্তু সে লফারের সঙ্গে ছিল না কেন? মরুভূমি পেরিয়ে লফার একা এল কেন?
এই সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। দেখা গেল হেডলাইট।
কাপারিলো বলল, ওই যে, ট্রেন আসছে।
পতাকা দেখিয়ে ট্রেন থামাল সে। একটা বক্সকার দেখিয়ে তাতে উঠে যেতে বলল ছেলেদের।
কাপারিলোর সাহায্যের জন্যে তাকে অনেক ধন্যবাদ দিল কিশোর আর রবিন। হাত মেলাল। অন্ধকারে গা ঢেকে উঠে পড়ল বক্সকারে।
কয়েকটা মালের বাক্স গার্ডের গাড়িতে তুলে দিল কাপারিলো। আবার চলতে শুরু করল ট্রেন।
.
১২.
বক্সকারের বিশাল খোলা দরজার পাশে হাঁটু মুড়ে বসেছে কিশোর আর রবিন। ভেতরে আলো নেই। বাইরে চাঁদের আলো। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সীমাহীন বালির রাজত্বে ছোট ছোট ঝোপঝাড় আছে। কোথাও মাথা তুলেছে পাথরের পাহাড়। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বুনো জানোয়ার। আর কচিত-কদাচিত চোখে পড়ে একআধটা নিঃসঙ্গ মাটির তৈরি বাড়ি, এই এলাকায় অ্যাডবি নামে পরিচিত। এত রাতে আলো দেখা গেল না। কোন বাড়ির জানালায়।
এরপর কি করব আমরা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ট্রেনটা যতদূর যায়, যাব। লফার নিশ্চয় এইই করেছিল। গিয়ে দেখি, কি ঘটে?
অহেতুক বসে থেকে লাভ কি? একটু ঘুমিয়ে নিই। গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। বাপরে বাপ, যা ঝাঁকি! ঘুমানো লাগবে না!
কিশোরও শুয়ে পড়ল তার পাশে।
ঝাঁকি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ঘুম ভাঙল ওদের। ট্রেন থেমে গেছে। লোকের কথা শোনা গেল। একটা মুখ উঁকি দিল বক্সকারের দরজায়। হাসি হাসি একটা কণ্ঠ বলল, ওঠো, উঠে পড়ো। আমেরিকায় যাওয়া আর তোমাদের হলো না।
ইউনিফর্ম দেখেই চিনে ফেলল কিশোর। বিড়বিড় করল, মেকসিকান পুলিশ!
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। বর্ডার পুলিশ। মেকসিকোতে এটা শেষ স্টেশন। অবৈধ যাত্রীকে দেখলেই আমরা এখানে নামিয়ে নিই।
তারমানে মেকসিকালিতে এসে গেছি?
হ্যাঁ, এসেছ। নামো তো এবার, আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। দেরি দেখলে বিরক্ত হয়ে যাবে, ব্যঙ্গের সুরে বলল পুলিশ অফিসার।
বক্সকার থেকে নামিয়ে ট্রেনের সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো কিশোরদের। ইঞ্জিনের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। সবার পরনেই ময়লা, মলিন পোশক। দরিদ্র কৃষক কিংবা শ্রমিক শ্রেণীর লোক সবাই।
কারা ওরা? রবিনের প্রশ্ন।
কিশোর জবাব দিল, হবে হয়তো আমাদেরই মত টিকেট ছাড়া যাত্রী। বেআইনী ভাবে বর্ডার পার হতে চেয়েছিল, আটকে দিয়েছে পুলিশ।
বড় একটা লরির পেছনে তোলা হলো ওদের।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের? আবার প্রশ্ন করল রবিন।
জেলে হবে, আর কোথায়!
কিন্তু আমাদের জেলে নেবে কেন? আমরা তো অবৈধ ভাবে সীমান্ত পার হতে চাইনি!
চলতে শুরু করল লরি।
কিছুক্ষণ পর থানার শান বাঁধানো চত্বরে এসে ঢুকল। এগিয়ে এল কয়েকজন অস্ত্রধারী গার্ড। বন্দিদের নামিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হলো।
কিশোর আর রবিনকে লাইন থেকে বের করে দিল একজন অফিসার। আবার লরিতে ওঠানো হলো ওদের, তবে পেছনে নয়, সামনে, ড্রাইভারের পাশে। আবার পথে বেরিয়ে এল লরি। শহরের দিকে চলল।
অবাক হয়ে জানতে চাইল কিশোর, কি ব্যপিরি? আমাদের কোথায় নিচ্ছেন?
চোরাচালানি ধরার চেষ্টা করছে পুলিশ, জবাব দিল ড্রাইভার। তাই ট্রেন থেকে নোক নামিয়ে ধরে এনেছে। তোমরা নিশ্চয় তিন গোয়েন্দার লোক? শহরে নিয়ে গিয়ে তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাকে। সেটাই করছি।
আশ্চর্য! রবিন বলল। আমাদের নাম জানল কি করে?