আকাশে তারার মেলা। নীরব রাত। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মাঝে নির্জন বালির চরায় শুয়ে থাকা। সে এক বিচিত্র অনুভূতি। খুব ভাল লাগছে কিশোরের। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, জন্মটা সার্থক।
নিরাপদে রাত কাটল। পরদিন ভোরে রওনা হলো আবার ওরা। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ইয়োমাতে পৌঁছে থানায় খোঁজ নিতে চলল। ওদেরকে স্বাগত জানাল ডিউটি অফিসার। নাম শুনে চিনতে পারল। লঞ্চ থেকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে তার কাছে, বোঝা গেল।
তবে গোয়েন্দাদের নিরাশ করল অফিসার। বোট চোরকে ধরা যায়নি। পুলিশের হাত ফসকে পালিয়ে গেছে লোকটা। তার পরিচয়ও জানতে পারেনি পুলিশ।
থানা থেকে বেরিয়ে বোটে এসে উঠল দু-জনে। তারপর আবার এগিয়ে চলী।
.
১১.
দুপুরের পর সীমান্ত পেরিয়ে মেকসিকোর সোনোরা রাজ্যে ঢুকল ওরা। চেকপোস্টে খুব কড়াকড়ি। ডিউটি অফিসার ওদের জানাল, চোরাচালানি আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা নাকি ইদানীং খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। লফার আর ব্রাউনের কথা অফিসারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কিন্তু কিছু বলতে পারল না অফিসার।
বিকেলের ভয়ানক কড়া রোদের মধ্যে এগিয়ে চলল বোট।
বেশ কয়েক মাইল এগোনোর পর নদীর তীরে কয়েকটা ঝোপের ধারে পাঁচ-ছয়টা ছেলেমেয়েকে জটলা করতে দেখা গেল। নদীতে গোসল করতে এসেছে ওরা। সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর এই প্রথম মানুষ দেখতে পেল। গোয়েন্দারা। বচ্চিাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল ওরা।
ওরাও বোট দেখে এগিয়ে এল। কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল। স্থানীয় ইনডিয়ানদের ছেলেমেয়ে।
হাত নেড়ে ডাকল কিশোর। কিন্তু কাছে এল না ওরা। ভয় পাচ্ছে। শেষে এক বুদ্ধি করল সে। বোট থেকে মাটিতে নেমে পকেট থেকে চিউয়িং গাম বের করল। এইবার গুটিগুটি এগিয়ে এল ছেলেমেয়েগুলো।
সহজেই ভয় কাটিয়ে দিল ওদের কিশোর আর রবিন। ইংরেজি জানে না ওরা, তবে স্প্যানিশ বোঝে। ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে ওদের কাছে জানতে চাইল, কোন বিদেশীকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছে কিনা।
একটা ছেলে জবাব দিল, দেখেছে। এই প্রথম হ্যাঁ-বাচক জবাব পেয়ে সতর্ক হলো গোয়েন্দারা। ছেলেটার বাড়ি কোথায়, জিজ্ঞেস করল। হাত তুলে পাহাড়ের দিকে দেখিয়ে দিল ছেলেটা।
বোট ঘাটে রেখে ছেলেটার সঙ্গে ওদের বাড়িতে চলল দুই গোয়েন্দা, তার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। দল বেঁধে ওদের সঙ্গে চলল বাকি ছেলেমেয়েগুলো। চিউয়িং গাম পেয়ে খুব খুশি ওরা। যে কোন সাহায্য করতে রাজি।
পাহাড়ের কোলে ওদের বাড়িঘর। যে ছেলেটী বিদেশী লোক দেখেছে বলেছে, তার বাবা কৃষক। ছেলের কথা সমর্থন করল। বলল, আমি দেখিনি, তবে শুনেছি। রিটার দিকে গেছে। আমেরিকান।
কি করে গেছে, জানতে চাইল কিশোর।
কৃষক জানাল, মরুভূমি দিয়ে এসেছিল লোকটা। কয়েক মাইল দূরে রেলস্টেশন আছে, রেলগাড়ি চলাচল করে। লোকটা লাইন ধরে হেঁটে গেছে সভবত স্টেশনে, তারপর গাড়িতে করে গেছে, ঠিক জানে না কৃষক।
কোন দিকে কি ভাবে যেতে হবে, জেনে নিল কিশোর। রবিনের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করল, ওরাও ওই পথেই যাবে। তাহলে হয়তো আরও খোঁজ মিলতে পারে। ঘাটে বোট রেখে যাবে। কৃষককে অনুরোধ করে বলল, সে বোটটা দেখেশুনে রাখতে রাজি হলে তাকে টাকা দেয়া হবে।
রাজি হলো কৃষক। অতএব আর কোন দ্বিধা নয়। রেললাইনের দিকে হাঁটা শুরু করে দিল দুই গোয়েন্দা।
কয়েকশ গজ এগোতেই চোখে পড়ল রেললাইন।
ঘড়ি দেখল কিশোর। ছটা বাজে। রেললাইন ধরে এগোলে রাতের আগে পৌঁছে যেতে পারবে স্টেশনে।
স্লীপার আর লাইনে ফেলে রাখা পাথর মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ওরা।
ঘণ্টাখানেক চলার পর লাইনের ধারে ছোট একটা বাড়ি দেখা গেল। ওটাই স্টেশন। সেখানে এসে দেখা গেল একজন মাত্র লোক স্টেশনটা চালাচ্ছে। স্টেশন মাস্টার থেকে লাইনম্যান–সব সে একাই। তার নাম কাপারিলো। বিদেশী এবং আমেরিকা থেকে এসেছে শুনে বিশেষ খাতির করতে লাগল। ওরা গোয়েন্দা শুনে খাতিরের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল।
জানা গেল, কিছুক্ষণ পরই একটা মালগাড়ি আসবে, উত্তরে মেক্সিকালিতে যাবে। কিশোররা যেতে চাইলে তাতে ওদেরকে তুলে দেয়া সম্ভব হবে, এবং ওরা গোয়েন্দা বলেই এই কাজটা করতে রাজি আছে কাপারিলো। তবে যেহেতু মালগাড়িতে করে যাবে, টিকেট দিতে পারবে না। মালগাড়ি যাত্রী বহন করে না, সুতরাং টিকেট দেয়ারও নিয়ম নেই।
কথায় কথায় কিশোর জানতে চাইল, আচ্ছা, কিছুদিনের মধ্যে আর কোন আমেরিকানকে এ স্টেশনে আসতে দেখেছেন? গত দু-তিন মাসের মধ্যে?
একটা মুহূর্ত নীরব থেকে মনে করার চেষ্টা করল যেন কাপারিলো। বলল, দেখেছি। ছোট্ট স্টেশন, যাত্রী খুব কম আসে। বিদেশী তে আরও কম। সে জন্যেই মনে আছে। কয়েক হপ্তা আগে একজন ঠিক এ রকম সময়েই হেঁটে এসে হাজির। স্টেশনে মালগাড়ি থামলে আমরা মাল খালাস করছি, এমন সময় দেখি চুরি করে একটা বগিতে উঠে পড়ল লোকটা।
হবে হয়তো কোন ভবঘুরে, রবিন বলল। টাকা ছিল না, তাই চুরি করে উঠেছে।
আমিও তাই ভেবেছি। গিয়ে ধরলাম। কাকুতি-মিনতি শুরু করল। লোকটা। বলল, আমেরিকা থেকে এসেছে। গাড়িতে থাকতে দিতে বলল। কারা নাকি তাকে তাড়া করেছে।
পুলিশ? বেআইনী ভাবে মেকসিকোতে ঢুকেছে লোকটা?
কাঁধ ঝাঁকাল লোকটা। তা তো জানি না। মরুভূমির ওপর দিয়ে অনেক পথ হেঁটে এসেছে। ওর অবস্থা দেখে দুঃখই লাগল। হঠাৎ মরুভূমির রাস্তায় হেডলাইট দেখলাম। একটা গাড়ি আসছিল। দেখেই লোকটা বলল, তাকে ধরতে আসছে ওরা। ট্রেনটা তখন ছাড়ার সময় হয়েছে। ভাবলাম, থাকগে, যকি। সত্যি হয়তো বিপদে পড়েছে লোকটা।