দূ-তীরের একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে খুব শিগগিরই চোখ পচে গেল কিশোরের। সময় কাটানোর জন্যে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরতে বসল।
কয়েকটা বালির চরার পাশ কাটাল ওরা। ব্লাইদি থেকে একটা রাস্তা নদী পার হয়ে চলে গেছে, নদীর ওপরে ব্রিজ। সেটার নিচ দিয়ে পার হয়ে এল। বোট। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বিশাল আকারের কৈ মাছ ধরে ফেলল কিশোর।
দূরে দেখা গেল রিপ্লির পাহাড় চূড়া। টিলাও চোখে পড়ল। চিনতে পারল। ওখানেই রয়েছে দানবীয় নকশাগুলো।
দুপুরের আগে তীরে বোট ভেড়াল রবিন। মাছগুলো নিয়ে নেমে পড়ল দু জনে। আগুন জ্বেলে রান্না করে খেতে বসল।
ইমপেরিয়াল ড্যাম আর বেশি দূরে নেই, রবিন বলল। পাঁচ ঘণ্টার বেশি তো চললাম।
খাওয়ার পর আবার বোট ছাড়ল ওর। কিছুক্ষণ পরেই বাঁধটা চোখে পড়ল। কাছে এসে ডকে বোট ভেড়াল। এই প্রথম একটা বড় ধরনের লোকালয় পাওয়া গেল। মানুষজন যা আছে, বেশির ভাগই জেলে, ডক শ্রমিক, ট্রাক ড্রাইভার।
এক ড্রাইভারের সঙ্গে খাতির করে ফেলল কিশোর। লফার আর ব্রাউনের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইল ওদের দেখেছে কিনা।
ড্রাইভার বলল, দেখেনি। ওরা অনেক দূর থেকে খুঁজতে এসেছে শুনে আরও কয়েকজন ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করল সে। কেউ কিছু বলতে পারল না।
ওদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বোটে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। আবার বোট ছাড়ল। হাল ধরল কিশোর। আধমাইল মত যাওয়ার পর হঠাৎ একটা বালির টিবির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দেখো, দেখো, সেই বেয়ারাটী!
.
১০.
শাই করে সেদিকে বোটের নাক ঘুরিয়ে দিল কিশোর। মাঝনদীতে রয়েছে। ওরী। কিনারে পৌঁছে বোট ভিড়িয়ে ডাঙায় নামতে নামতে অনেক সময় লাগিল। ঢিবির ওপারে আর দেখা গেল না লোকটাকে। বড় বড় পাথর আর পাহাড় রয়েছে ওখানে। কোথায় লুকিয়েছে কি করে খুঁজে বের করবে?
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে লোকটাকে না পেয়ে আবার বোটে ফিরে এল ওরা। টিবিটীর কাছে পানিতে একটা সবুজ ঘোট মোটরবোট নোঙর করা। রবিন বলল, এই বোটে করেই হয়তো এসেছে ব্যাটা। খানিকটা এগিয়ে বসে থাকি চুপচাপ। এক সময় না এক সময় আসতেই হবে তাকে।
আবার নদীর মাঝখানে এসে নোঙর ফেলে মাছ ধরার ভান করতে লাগল দু-জনে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা লোক এসে বোটে উঠল। গায়ে নীল শার্ট। কিন্তু সে বেয়ারা নয়। তবে যে ভাবে ওদের বোটটার দিকে তাকাচ্ছে, সেটা সন্দেহজনক।
বোট ছাড়ল সে। মেকসিকোর দিকে যেতে লাগল। কোথায় যায়, দেখার জন্যে পিছু নিল গোয়েন্দারা। ওদের ধারণা হলো, সামনে কোথাও গিয়ে অপেক্ষা করবে বেয়ারার ছদ্মবেশী লোকটা। নীল শার্ট পরা লোকটা বোট তীরে ভিড়িয়ে তাকে তুলে নেবে।
আধ মাইল এগোনোর পর যেন ওদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল লোকটা। বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। শেষে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে ভেসে রইল। ওরা কাছাকাছি হলে হাত নেড়ে ডাকল।
বোট কাছে নিয়ে গেল কিশোর।
ককশ স্বরে জিজ্ঞেস করল লোকটা, আমার পেছনে লেগেছ কেন?
নিরীহ স্বরে কিশোর জবাব দিল, কই? আপনি যেদিকে যাচ্ছেন আমরাও সেদিকে যাচ্ছি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইল লোকটা। আবার বোট ছাড়ল। আগের মতই পেছনে লেগে রইল গোয়েন্দারা।
ল্যাশুনা ড্যাম দেখা গেল। রিজারভয়েরের ভেতরে ঢুকে আবার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল লোকটা। কিশোরদের ডেকে বলল, এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকব!
ডাকুন না, জবাব দিল কিশোর। অন্যায় কিছু করিনি আমরা।
রবিন বলল, আপনার আর ডাকার দরকার হবে না। ওই যে পুলিশ আসছে।
পুলিশের লঞ্চ দেখেই ঘাবড়ে গেল লোকটা। গতি বাড়িয়ে ছুটতে শুরু করল। বাধা পেরিয়ে গিয়ে তীরে ভেড়াল নৌকা। লাফিয়ে ডাঙায় নেমে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দূরবীন চোখে লাগিয়ে বোটটাকে দেখছে একজন অফিসার। কাছাকাছি বোট নিয়ে গেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে, অফিসার? বোটটা চুরি করে এনেছে ও, অফিসার জবাব দিল। সকালে রিপোর্ট করা হয়েছে আমাদের কাছে। তোমরা মনে হলো ওটার পিছু লেগেছিলে? কেন?
অল্প কথায় বুঝিয়ে বলল কিশোর, ওরা গোয়েন্দা। নিখোঁজ একজন মানুষকে খুঁজতে বেরিয়েছে। বেয়ারার ছদ্মবেশী লোকটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কি করে সবুজ বোটের পেছনে লেগেছে বলল।
কিশোররা মেকসিকোতে যাচ্ছে শুনে অফিসার বলল, নোকটাকে ধরতে যাচ্ছি আমরা। কি করতে পারলাম জানার ইচ্ছে থাকলে ইয়োমাতে গিয়ে থানায় খোঁজ কোরো। মেসেজ দিয়ে রাখব।
গতি বাড়িয়ে চলে গেল লঞ্চটা।
কিশোররাও এগোতে থাকল। পথে যেখানেই মানুষ-জন দেখতে পেল, জেলে নৌকা দেখল, থামিয়ে লফার আর ব্রাউনের খোঁজ নিল। কিন্তু ওরকম কাউকে দেখেছে বলে কেউ বলতে পারল না।
কেটে গেল দিনটা। সূর্য ডুবল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হতে লাগল। নদীর কিনারে আর পানির ওপর পোকা খুঁজতে বেরোনো পাখিগুলোকে অস্পষ্ট লাগছে। আকাশের পটভূমিতে বাদুড়ের দলকে লাগছে কেমন অপার্থিব।
থামার সময় হয়েছে, কিশোর বলল।
নদীর মাঝে একটা বালির চরার ধারে নোঙর ফেলল ওরা। খাবারের টিন আর স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে নামল। ওখানেই ক্যাম্প করে রাত কাটানোর ইচ্ছে।
আগুন জেলে রান্না করতে বসল রবিন। হাত-পা ছড়িয়ে পাশে বসে রইল কিশোর। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল মাংস ভাজার সুগন্ধ। মাখন মাখানো পাউরুটি, ভাজা মাংস, পনির, আপেলের সস, আর টিনে করে আনা সেদ্ধ বাঁধাকপি দিয়ে খাওয়া সারল ওরা। ঢুকে পড়ল স্লীপিং ব্যাগের মধ্যে।