এখনও ঝুঁকে বসে আছে কিশোর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাকার দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। সেগুলো রবিনকে দেখিয়ে বলল, মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে পালাতে চেয়েছিল লেসলি।
রবিন জিজ্ঞেস করল, কার কাছ থেকে? কেন?
উঠে দাঁড়াল কিশোর। মলের দিকে তাকাল। কখন শেষ পিজ্জাটা ডেলিভারি দিয়েছিল লেসলি?
ফাইল দেখল রবিন। এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। কেন?
এগারোটার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় এখানকার সব স্টোর, ভিডিও আর্কেডের ওপর স্থির হলো কিশোরের দৃষ্টি। সম্ভবত এই আর্কেডটা বাদে।
*
আর্কেডের ভেতরের মান নীলচে আলো চোখে সইয়ে নিতে সময় লাগল তিন গোয়েন্দার। সামনের কাউন্টারে বসে কয়েন গুণে গুণে কাগজের টিউবে ভরে রাখছে একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে।
দশ…এগারো-বারো… গুণছে সে। কাউন্টারে ঝুঁকে গভীর মনোযোগে কাজ করছে। প্রতিটি মুদ্রা ভালমত দেখছে। তেরো…
এক্সকিউজ মি! ছেলেটার প্রায় কানের কাছে গিয়ে বলল রবিন।
ময়লা একটা আঙুল তুলে রবিনকে অপেক্ষা করতে ইশারা করে গুণে চলল ছেলেটা। তেরো…উম, চোদ্দ-..
কিশোরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল রবিন
অহেতুক দাঁড়িয়ে না থেকে আর্কেডের ভেতরটা দেখতে শুরু করল কিশোর। মুসা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
ছেলেটার দিকে ঘুরল রবিন। আগের চেয়ে জোরে বলল, এক্সকিউজ মি, প্লীজ!
ঘর্মাক্ত, গোলআলুর মত একটা গোল মুখ ঘুরল রবিনের দিকে। ছোট ছোট দুই চোখের দৃষ্টি স্থির হলো ওর মুখের ওপর। অবাক হয়ে ভাবতে লাগল। রবিন, ছেলেটার মুখ কি কোনকালে বন্ধ হয়? নাকি সব সময়ই ওরকম অর্ধেক ফাঁক হয়ে খুলে থাকে?
অপেক্ষা করছে রবিন। কি চাই, কি সাহায্য করতে পারি, এ ধরনের কোন প্রশ্নের অপেক্ষা। কিন্তু কিছুই বলল না ছেলেটা। তাকিয়ে রইল হাঁ করে। শেষে রবিনকেই কথা শুরু করতে হলো, কি নাম তোমার?
আঁ? এই একটা শব্দ উচ্চারণ করে আবারও দীর্ঘ মুহূর্ত রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। আস্তে করে মাথা ঝাঁকিয়ে যেন কথা বের করার চেষ্টা চালাল মগজের ভেতর থেকে। শেষে কোনমতে বলল, পটেটো।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। হাসল। চমৎকার নাম। একেবারে মানানসই। পটেটো, তোমার একটা মিনিট সময় নষ্ট করতে পারি আমি?
হ্যাঁ, মলিন হাসি হাসল পটেটো। বলো।
জ্যাকেটের পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করল রবিন। পটেটোকে দেখিয়ে বলল, আমি একজন গোয়েন্দা।
পলকে পটেটোর প্রায় ফ্যাকাসে মুখটা আরও রক্তশূন্য হয়ে যেতে দেখল সে। ইঁদুরের মত চি চি করে উঠল, তো আমি কি করব?
কার্ডটা সরিয়ে রাখল রবিন। কাল রাতেও কি এখানে তোমারই ডিউটি ছিল?
মাথা ঝাঁকাল পটেটো, হ্যাঁ। রোজ রাতেই থাকে।
একটা ছবি দেখাল রবিন, এই লোকটাকে চিনতে পারো?
ছবিটা দেখল পটেটো। কুঁচকে যাচ্ছে ভুরু। দ্রুত চিন্তা চলেছে তার মনে, মুখ দেখেই বোঝা যায়। নাহ্, অবশেষে জবাব দিল সে, কখনও দেখিনি।
এমনভাবে মানা করে দেবে ছেলেটা, ভাবেনি রবিন। বলল, দেখো না, আরেকটু ভালমত দেখো। কাল রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে এখানে এসেছিল সে।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগল পটেটো। যেন কে ঢুকল কে বেরোল এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই তার। ভঙ্গি দেখাল যেন কথাও বুঝতে পারছে না।
এমন সরাসরি মিথ্যে বলছে ছেলেটা! এভাবে যে মিথ্যে বলে তার মুখ থেকে কথা আদায় করা কঠিন। অসহায় বোধ করল রবিন। মুসার দিকে তাকাল।
পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল পটেটোর দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শোনো, আলু মিয়া, মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তোমাদের পার্কিং লটে খুন হয়েছে ছবির এই লোকটা, পড়ে থাকা আধপোড়া গাড়িটা দরজা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখিয়ে বলল, ওই যে ওটা এর গাড়ি। ওই সময় তুমি এখানে থাকলে দৃশ্যটা তোমার চোখে না পড়ার কথা নয়। একটা গাড়ি আগুনে পুড়ছে, আর তুমি কিছু দেখোনি…
তাই তো, আস্তে করে বলল পটেটো। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। ওপর-নিচে দ্রুত ওঠানামা শুরু করল তার মাথা। মুসার বাহুর শক্তিশালী পেশীর দিকে তাকিয়ে যেন হঠাৎ করে মনে পড়ে গেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল নিগ্রো ছেলেটার ঘুসি ছুটে আসছে কিনা তার গোল নাকের ডগাটাকে ভোঁতা করে দেয়ার জন্যে। হায় হায়… গাড়ির দিকে আঙুল তুলে সেটা আবার ঠেকাল রবিনের হাতের ছবিতে, এই লোকটাই সে?
*
আর্কেডের একেবারে পেটের মধ্যে সারি সারি ভিডিও গেম মেশিনের পাশ দিয়ে চলেছে কিশোর। ওগুলোর সামনে দাঁড়ানো ছেলেগুলো বেশির ভাগই তার সমবয়েসী, কেউ দুএক বছরের ছোট, কেউ বড়। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ তুলে কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। হয়তো ভাবছে ওদের মতই কিশোরও ভিডিও গেম খেলতে এসেছে।
একটা ক্লাসিক উরটিজার জুকবক্সের পাশ কাটাল সে। কমপ্যাক্ট ডিস্ক লাগানো আছে ওটাতে। ভিডিও গেম মেশিনগুলোর কাছে কেমন ভারিক্কি দেখাচ্ছে ওটার চেহারা।
মেশিনগুলোর পাশ কাটাতে গিয়ে একটা মেশিন দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। থমকে দাঁড়াল। Virtual Massacre-II মেশিন। পর্দায় স্তম্ভ তৈরি করে ফুটছে খেলে রেখে যাওয়া খেলোয়াড়দের নাম, সই, তারিখ আর সময়। একটার নিচে আরেকটা।
তাকিয়ে রইল কিশোর। নামের সারি শেষ হতেই একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য, ফুটল। একজন যোদ্ধা কারাতের কোপ দিয়ে মেরে ফেলল আরেকজন যোদ্ধাকে। মুমূর্ষ যোদ্ধার মুখ থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে এল এক ঝলক রক্ত। পরক্ষণে বলে উঠল একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ: খেলবে, এসো। আমি জানি তোমার পকেটে একটা সিকি আছে: