বাতাস বইতে শুরু করল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। ওপর দিকে তাকাল সে। পাহাড়ের ঢালে বনের আড়ালের অবজারভেটরিটা দেখার চেষ্টা বেকরল। লোকে বলে ওটার লাইটনিং রডগুলোই যখন-তখন বিদ্যুৎ-ঝড়ের সৃষ্টি। করে এখানে। ওটা তৈরি করার আগে ঝড়বৃষ্টি হলেও এত বজ্রপাত হত না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শহরবাসীকে বুঝিয়েছে, ওটা হওয়াতে বরং ভাল হয়েছে ওদের। লাইটনিং রডগুলো বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে, টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। লোকের মাথায় পড়ে না আর।
বৃষ্টির বেগ এতটাই বেড়ে গেল, না দৌড়ে আর পারল না বিলি। আরও আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বিদ্যুতের আলোয় দূরে চোখে পড়ছে ওদের বাড়িটা। লম্বা লম্বা ঘাস। এমনিতেই হাঁটতে বাধা দেয়। ভিজে গিয়ে অক্টোপাসের শুড় হয়ে গেল যেন। পা জড়িয়ে ধরে রাখতে চাইছে কেবলই। বুটের চাপে হুস হুস শব্দ হচ্ছে। দৌড়ানো কঠিন করে তুলল বিলিল জন্যে।
চতুর্দিক আলোকিত করে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাল হঠাৎ। এতক্ষণ যেগুলো চমকেছে, তার চেয়ে আলো অনেক বেশি। পরক্ষণে বিকট শব্দ। বিলির মনে হলো আকাশটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তার নিজের মাথাটাও। শরীরে এমন তীব্র ব্যথা আর কখনও অনুভব করেনি। চিৎকার করতে চেয়েছে। মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয়নি। শরীরের সমস্ত পেশী যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিল। চুলে আগুন ধরে গিয়েছিল।
সাতদিন পর জ্ঞান ফিরেছিল ওর। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। মমি বানিয়ে ফেলা হয়েছিল দেহটাকে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিল সে। কেউ ছিল না পাশে।
প্রথমে দেখা করতে এলেন মা। এসেই শুরু করলেন বকাবকি, চিৎকার, চেঁচামেচি। বোকার মত ঝড়বৃষ্টি দেখেও মাঠের মধ্যে দিয়ে আসতে গিয়েছিল কেন সে, তার জন্যে একশো একটা কথা শোনালেন। গালাগালে তেতো হয়ে গিয়েছিল তার মন।
পটেটোও দেখা করতে আসেনি। আসার উপায় ছিল না ওর। অসুখ হয়ে সে-ও তখন হাসপাতালে।
ছাড়া পাওয়ার একদিন আগে এসে একমুঠো রজনীগন্ধার সুবাস ছড়িয়ে যেন তার সঙ্গে দেখা করল মিলি হাওয়ার্ড। একটি কুকিজ নিয়ে এসেছিল তার জন্যে। সেই সঙ্গে একটা সুখবর। তার বাবা একজন লোক খুঁজছেন। ওদের গ্যারেজের কাজের জন্যে। বিলির কথা বলেছে মিলি। বাবা রাজী হয়ে গেছেন। আপাতত একটা বেতন ধার্য করা হয়েছে। কাজ দেখাতে পারলে ভবিষ্যতে চাকরির পদোন্নতি হবে এবং বেতনও বাড়বে।
মিলিকে ওই মুহূর্তে দেবী মনে হয়েছিল বিলির। তার অন্ধকার বিরক্তিকর জীবনে আলোর মত। তখনই ঠিক করে ফেলেছিল, ওকে সুখী করবে সে। জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে। সেটা করার জন্যে যা যা দরকার, সব করবে।
এর দুদিন পর একটা টর্চ লাইটের বাতিল ব্যাটারি বদলাতে গিয়ে নিজের ক্ষমতাটা প্রথম টের পেল বিলি। এতটাই চার্জ হয়ে গেল ব্যাটারি, টর্চের বাল সেটা সহ্য করতে না পেরে কেটে গেল। ব্যাটারিগুলো ফেটে গিয়ে অ্যাসিড গলে বেরিয়ে হাতে লাগল তার। শুরু হলো একটার পর একটা পরীক্ষা। দুই ঠোঁটে বা চেপে ধরে আলো জ্বেলে পটেটোকে অবাক করে দিল।
প্রথমে ব্যাপারটা খুব মজার মনে হয়েছে ওর কাছে।
কিন্তু এখন আর মজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জরুরী কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক করে ফেলেছে সে নিজেই।
ঘরে বসে কথাগুলো ভাবছিল বিলি, এই সময় গাড়ির আওয়াজ শুনল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, তিন গোয়েন্দা নামছে গাড়ি থেকে।
*
দরজায় দাঁড়ানো গোয়েন্দাদের ফাঁকি দেয়ার জন্যে বেডরূমের জানালা দিয়ে। বেরিয়ে গেল বিলি। বিদ্যুৎ যেন প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়তে চাইছে তার ভেতরে। মাঠের ওপর দিয়ে ছুটল সে।
কিন্তু দেখে ফেলল গোয়েন্দারা।
বিলি! বিলি! ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসতে লাগল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা।
একবার ভাবল বিলি, দৌড়ে পালায়। কিন্তু পালিয়ে কোন সুবিধে করতে পারবে না, বুঝে গেছে। বরং ওরা কি বলে শোনা যাক। ইস, মস্ত ভুল হয়ে গেছে! ঝোঁকের মাথায় হাওয়ার্ডের ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলার পর থেকেই ভাবছে সে। আরও সময় নিলে পারত। চৌরাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটানোর পর পরই ওরকম একটা কাণ্ড না ঘটিয়ে অন্য কোথাও অন্য কোন সময় কাজটা করা উচিত ছিল। তাতে ওর ওপর সন্দেহ জাগত না কারও। আরও একটা বড় ভুল হয়ে গেছে–পটেটোর সামনে এটা করা।
পটেটো ওর বন্ধু, ঠিক আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর গলার কাঁটা না হয়ে ওঠে।
মাঠের মাঝখানে এসে তাকে ধরে ফেলল তিন গোয়েন্দা। কিশোর তার হাত ধরল। ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল বিলি। দাঁত কিড়মিড় করল। রাগে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।
ধোরো না! আমাকে থোরো না! চিৎকার করে উঠল বিলি। ওখানেই তিনজনুকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করল। তাহলে রেহাই পাবে সে। ওরা আর বিরক্ত করতে পারবে না।
কিন্তু জানে একাজ করা উচিত হবে না। এরা মরলে পুলিশ আর গোয়েন্দা বিভাগের কড়া নজর পড়ে যাবে ওর ওপর। পিলপিল করে পিঁপড়ের সারির মত আসতে আরম্ভ করবে ওরা। ওকে ধ্বংস না করে ছাড়বে না।
বিলির রাগ দেখে পিছিয়ে গেল কিশোর। ঠিক আছে, ধরব না।
আর কখনও আমাকে ছোবে না বলে দিলাম!
তোমার সঙ্গে আমাদের কথা আছে, বিলি, ওকে শান্ত করার জন্যে বলল রবিন।
কি কথা? আমি কিছু করিনি, নিজের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। কথাটা বিলির।