বিশেষ গুরুত্ব দিল না মুসা। কাজেই ফারিহার কাছ থেকে উঠতে উঠতে অন্ধকার হয়ে গেল। তখন আর টমের ঠিকানা খুঁজে বের করার সময় নেই। অত অন্ধকারে কে একটা গোবেচারা বয়ফ্রেন্ডের ঠিকানা খোঁজার মত ফালতু কাজ করতে যায়? রোববারের আগে আর কাজটা করতে পারল না মুসা। গাড়ি এনে রাখল লরেল স্ট্রীটে, ২৮ নম্বর বাড়ির সামনে, যেখানে বাস করে টমাস হামবার।
রকি বীচের কয়েক মাইল উত্তরে মেলটনের শান্ত সুন্দর পরিবেশে বাড়িটা। পথের পাশে একসারি সাদা কাঠের বাড়ি। সামনে চওড়া বারান্দা আর ছোট আঙিনা।
টমাসদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরানো বনেভিল কনভারটিবল গাড়ি। বারান্দার রেলিঙের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে সোনালি চুলওয়ালা এক তরুণ। পরনে রঙচটা নীল জিনস, গায়ে সাদা টি-শার্ট। মুসা আঙিনায় ঢুকতেই লাফ দিয়ে রেলিং থেকে নামল সে।
এসো! চিৎকার করে ডাকল সে। এক হাত সামনে বাড়ানো, আরেক হাত পিঠের পেছনে। দিনটা মাটি হতে বসেছিল আমার! তুমি আসাতে সেটা আর হলো না! মুসা বারান্দার কাছাকাছি যেতেই পেছনের হাতটা সামনে চলে এল। শক্ত করে ধরা একটা মোটর সাইকেলের চেন।
ব্যাপার কি? গতি বেড়ে গেল মূসার হৃৎপিন্ডের। হঠাৎ করে, কোন কারণ ছাড়াই একটা উন্মাদ হামলা করতে আসছে কেন তাকে! চেনের একটা মাথা হাতে পেঁচানো, আরেক মাথা ঝুলছে সাপের লেজের মত। স্থির হয়ে গেছে মুসা। কারাতের কৌশল ব্যবহার করবে? না পিছিয়ে যাবে?
এবার শুধু তুমি আর আমি, লোকটা বলল। এই তো চেয়েছিলে, তাই না? বলেই শপাং করে বাড়ি মারল কাঠের রেলিঙে।
না, কারাতের কথা ভুলে যাওয়াই উচিত। ওই চেনের এক বাড়ি মাথায় লাগলে সাতদিন হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে। পিছাতে শুরু করল সে।
শিক্ষা আজ ভাল করেই দিয়ে দেব! চিৎকার করে উঠল আবার লোকটা। লাফিয়ে বারান্দা থেকে আঙিনায় নামল। বেশি বড় শরীর না। অর্থাৎ গায়েগতরে মুসার চেয়ে ছোট খাটোও, স্বাস্থ্যও খারাপ। কিন্তু চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে, আর মাথার ওপরে তুলে বনবন করে ঘোরাচ্ছে চেনটা।
আপনি ভুল করছেন, মুসা বলল। সে পিছাচ্ছে আর লোকটা এগোচ্ছে। লোকটার পায়ে চামড়ার বুট। গরিলার মত বাঁকা করে রেখেছে কাঁধ।
আপনি কি ভাবছেন বুঝতে পারছি না, মুসা বলল আবার। আমি এসেছি টমাস হামবারের খোঁজে, মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। আমি জুন লারসেনের বন্ধু।
থমকে গেল কালো বুট। থেমে গেল চেনের পাক।
সত্যি বলছ? লোকটা বলল।
কসম, মাথা ঝাকাল মুসা। সতর্ক রয়েছে। লোকটা হঠাৎ আক্রমণ চালালে যাতে ঠেকাতে পারে।
সরি, চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফোস করে ছাড়ল লোকটা। ঢিল হয়ে গেল যেন সমস্ত শরীর। আমিই টমাস হামবার। জ্বালিয়ে খাচ্ছে আমাকে। চুরি করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে ওরা। ভবঘুরে। একটা লোক তো শাসিয়েই গেছে সুযোগ পেলেই আমার গাড়িটা চুরি করে নিয়ে যাবে।
রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা ঝরঝরে বনেভিলটা দেখাল টম।
ওটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। অবশেষে হেসে রসিকতা করল, এমনিতেই ওটা দিয়ে দেয়া উচিত। হাহ, হাহ! চাকা তো বসে গেছে। আর যে হারে তেল লিক করছে…
ব্যাটারিও ডাউন হয়ে আছে দুই হপ্তা ধরে, যোগ করল টম। হাসছে সে-ও। তবু, ওদেরকে নিতে দেব কেন? কেড়ে রেখেছি অনেক কষ্টে। ব্যাটারা হাড়-মাংস জ্বালিয়ে দিয়েছে আমার। কি বলছি বুঝতে পারছ? বারান্দার রেলিঙের দিকে চোখ পড়তে বলল, রেলিংটারই সর্বনাশ করলাম!…হ্যাঁ, জুনের সঙ্গে কি করে পরিচয় হলো তোমার, বলো তো?
আসলে, পরিচয় হয়নি এখনও, সত্যি কথাটাই বলল মুসা। আমার বান্ধবী আর ও একই রুমে রয়েছে হাসপাতালে।
ও, হ্যাঁ, দেখেছি একটা মেয়েকে, মুসাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে এল টম। চেন ঘোরাচ্ছে না। রাগও দূর হয়ে গেছে চেহারা থেকে। ওকে দেখতে আর ভয়ঙ্কর লাগছে না তখনকার মত। বরং ভদ্র, শান্ত একজন কলেজের ছাত্রের মতই লাগছে। ভেতরে আসবাবপত্রের চেয়ে পোস্টারই বেশি।
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম, মুসা বলল। শুক্রবার রাতে অত দেরি করে হাসপাতালে গিয়েছিলেন কেন?
খবরটাই পেয়েছি দেরিতে। জুনের রুমমেট হেনা ফোন করে আমাকে জানাল জুন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কয়েক মাস হলো ওর সঙ্গে আর ততটা দেখা হয় না, ঘনিষ্ঠতা নেই। তবু, একসময় তো ছিল, সেই সুবাদেই গেলাম দেখতে। হুঁশ ফিরেছে ওর?
না। বেহুশ ঠিক বলা যায় না, নার্স তাই বলল। গভীর ঘুম বলা যেতে পারে। ডাক্তারের কথা, অনেক বেশি ঘুম দরকার এখন ওর।
একটা মুহূর্ত আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে রইল টম। হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ল, যার সঙ্গে কথা বলছে সে পুরোপুরি অপরিচিত তার। একটা কথা জিজ্ঞেস করি, জুনকে যদি না-ই চেননা, তাহলে এসব প্রশ্ন করছ কেন?
ফারিহা, আমার গার্লফ্রেন্ড বলল, অদ্ভুত একটা কিছু ঘটছে। সেটারই তদন্ত করছি। চিকেন হার্বার্ট লারসেনকে চেনেন?
তাকে চিনব না। জুনের সঙ্গে আমার গোলমালটা বাধানোর জন্যে সে-ই তো দায়ী।
মানে? আপনাকে পছন্দ করতেন না তিনি?
কি করে করবে? সারাক্ষণই তর্ক বেধে থাকলে কি আর পছন্দ করে কেউ? আমি নিরামিষ ভোজী। মাছ খাই না, মাংস খাই না, মুরগীও ভাল লাগে না। খাবার জন্যে প্রাণী হত্যা আমার মতে অপরাধ। আর বেচারা প্রাণীগুলোকে খুন করে যারা ব্যবসা করে তারা তো রীতিমত অমানুষ। লাগত এসব নিয়েই। শেষ দিকে তো আমাকে দেখলেই জ্বলে উঠত লারসেন। আস্তে আস্তে এসব নিয়ে জুনের সঙ্গেও কথা কাটাকাটি শুরু হলো আমার। শেষে যখন বলল, গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাপের ব্যবসা দেখবে জুন, ব্যস, হয়ে গেল সব খতম। কাটাকাটি।