আলাপ শেষ। মহিলার চোখ দেখেই সেটা আন্দাজ করতে পারল কিশোর। একটানা ডিউটি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে আছে মারগারেট। মুখ গোমড়া করে রেখেছে। তাছাড়া কথা কম বলা স্বভাব। মেজাজ ভাল থাকলেও বলত না। এখন তো প্রশ্নই ওঠে না। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আরেক দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান।
এগিয়ে এসেছে রবিন। লালচে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ম্যাম, ব্যাপারটা জরুরী।
কড়া চোখে তাকাল মারগারেট। বিনিময়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল রবিন। তারপর ভদ্র কণ্ঠে বলল, ট্যালেন্ট এজেন্সিতে যে ভাবে মক্কেলদের পটায় সেভাবে, চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি! এ তো অমানবিক। নাহ, আপনার জন্যে মায়াই লাগছে আমার।
চোখের দৃষ্টি সামান্য নরম হলো মহিলার। রবিনের দিকে তাকিয়ে যেন সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছে, ভাগিয়ে দেবে না কথা বলবে। এত ভাল একটা ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা উচিত হবে না ভেবেই বোধহয় শেষে বলল, তিনজন তো নয়, দুজন এসেছিল। একটা ছেলে, আর একটা মেয়ে।
কেন, আর্মি জ্যাকেট পরা লোকটা? জানতে চাইল কিশোর। আসেনি?
বিস্ময় ফুটল মারগারেটের চোখে। আমি সাফ মানা করে দিয়েছিলাম, ঢুকতে পারবে না। আর বোলো না! লোকটাকে দেখলেই গা শিরশির করে। শুঁয়োপোকা দেখলে যেমন করে!
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
দেখতেই জানি কেমন। একের পর এক প্রশ্ন করে চলল। জবাব দিতে দিতে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় আমার। আর কি সব প্রশ্ন!
যেমন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটা কি বাঁচবে? যেন মরে গেলেই খুশি হয়। ওর জিনিসপত্রগুলো কোথায় রেখেছে, একথাও জানতে চাইল। আরও নানা রকম কথা। লারসেন পরিবারের লোক বলে মনে হলো না ওকে।
চেহারাটা দেখেছেন ভাল করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মাথা নাড়ল মারগারেট। লোকের মুখের দিকে কখনোই ভাল করে তাকাই না আমি। কেবল তার জ্যাকেট আর কথাগুলো মনে আছে। বদমেজাজী যে এটুকুও বুঝতে পেরেছি। তবে তার চেহারা বলতে পারব না।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সরে এল তিন গোয়েন্দা। কিশোর বলল, ধরা যাক, লোকটার নাম মিস্টার এক্স। এখন এই এক্সকে বিশেষ সুবিধের লাগছে না আমার। সন্দেহ জাগানোর মত চরিত্র। জুন হয়তো জানতে পারে লোকটার আসল পরিচয়। চলো, রুমে যাই। দেখি, জাগল কিনা।
অ্যাই, ছেলেরা, ওদের কথা শুনে ফেলেছে মারগারেট। জুনের অবস্থা কিন্তু খারাপ। ঘুম দরকার। ওর জাগতে সময় লাগবে।
তাহলে আর গিয়ে লাভ নেই। অহেতুক বসে থাকা। তার চেয়ে কাজের কাজ যদি কিছু করা যায় সেই চেষ্টা করল ওরা। মুসা রয়ে গেল হাসপাতালে। ফারিহাকেও সঙ্গ দেবে, জুনের কাছে কারা কারা আসে দেখবে, আর ওর ঘুম ভাঙে কিনা খেয়াল রাখবে। কিশোর আর রবিন চলল রকি বীচ পুলিশ স্টেশনে, চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে কথা বলতে।
আরেকটা ফোক্সওয়াগনই কিনেছে রবিন। গোবরে পোকার মত এই গাড়িগুলোই যেন তার বিশেষ পছন্দ। তার বক্তব্য, এই গাড়ি নাকি পথেঘাটে বন্ধ হয়ে বিপদে ফেলে না। যাই হোক, সেটা পরীক্ষার ব্যাপার। এই গাড়িটার রঙও আগেরটার মতই, লাল। সে বসল ড্রাইভিং সীটে। পাশের প্যাসেঞ্জার সীটে বসল কিশোর।
থানায় পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না। চীফ আছেন। ছেলেদের সঙ্গে দেখা করার ফুরসত আছে তার আপাতত। ওরা ঢুকে দেখল, লাঞ্চ প্যাকেট খুলছেন তিনি। চিকেন লারসেনের ফ্রাইড চিকেন।
খাবে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
থ্যাংকস, বলে হাত বাড়াল রবিন। তুলে আনল সোনালি মাখন মাখানো এক টুকরো মাংস।
কিশোরের দিকে তাকালেন চীফ। নাও?
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল কিশোর। খামচে ধরেছে চেয়ারের হাতল। যেন বিষ মাখানো খাবার খেতে দেখছে দুজনকে।
তারপর? জিজ্ঞেস করলেন ফ্লেচার। কোন কারণ ছাড়া তো নিশ্চয় আসনি। কি কেস? একটা রান তুলে নিয়ে কামড় বসালেন তিনি। চিবাতে লাগলেন। আরাম করে।
জুন লারসেনের অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপারে জানতে এলাম, জবাব দিল কিশোর।
ওতে কোন রহস্য নেই, মুখ ভর্তি মুরগীর মাংস নিয়ে কথা বলায় স্পষ্ট হচ্ছে না কথা। কাজেই গিলে নিলেন চীফ। বৃষ্টির মধ্যে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছিল। পাহাড়ী পথে এরপর যা হবার তাই হয়েছে।
অস্বাভাবিক কিছু নেই এর মধ্যে?
দুটো প্রশ্ন জেগেছে আমার মনে। তবে অনেক দুর্ঘটনার বেলাতেই এটা ঘটে। অপরিচিত একজন ফোন করে খবরটা দিল। ওই লোকটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা। অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটতে দেখে থাকতে পারে। তাতে কোন রহস্য নেই। কিন্তু নাম বলল না কেন? আরেকটা ব্যাপার। দুই সেট চাকার দাগ ছিল। একসেট জুনের গাড়ির। সোজা রাস্তা থেকে নেমে গেছে। আরেকটা সেট ছিল তার পাশে। যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, তার কাছ থেকে আরও খানিকটা নিচে নেমে গেছে।
কি ঘটেছিল, অনুমান করার চেষ্টা করল কিশোর। দুটো গাড়ি আসছিল। একটা আগে, আরেকটা পেছনে। একটা জুনের গাড়ি। অন্যটা কার? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করল সে। ভিন্ন একটা দৃশ্য ফুটতে শুরু করেছে মনের পর্দায়। স্যার, ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল সে, যেন নিজেকেই বোঝাল। একটা সম্ভাবনার কথা কি ভেবেছেন আপনি? এমনও তো হতে পারে, জুন লারসেনকে তাড়া করেছিল কেউ?
৩
তাড়া করেছিল? কোল্ড ড্রিংকের গ্লাসটা তুলে নিয়েছিলেন চীফ, আস্তে করে নামিয়ে রাখলেন আবার সেটা। কি ভাবছ তুমি, কিশোর, বলো তো? অতি কল্পনা করছ না তো?