ও-কে, কিশোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কাল সকাল এগারোটায় জুনের সঙ্গে কথা বলব। ভিজিটিং আওয়ার স্টার্ট হলেই চলে আসব। দেখা যাক, ঘুম ভাঙে কিনা, কিছু বলতে পারে কিনা স্বপ্নের ব্যাপারে।
ভালই হয় এলে। তবে আমি বাজি রেখে বলতে পারি, রহস্য একটা আছেই। পেয়ে যাবে।
কাল সকালে দেখা হবে, ফারিহা, মুসা বলল।
লাইন কেটে দিল কিশোর।
সে রাতে ভালমত ঘুমাতে পারল না কিশোর। ভাবছে, কোন লোকটা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিষ খাওয়াতে চায়? কেন? চিকেন লারসেন? নাকি কোন খেপাটে সন্ত্রাসী, যার দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে জুন? নাকি লারসেনের ব্যবসার ক্ষতি করার জন্যে কেউ বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে মুরগীর মাংসে তৈরি তার বিখ্যাত খাবারগুলোতে?
রাত একটায় রবিনকে ফোন করল কিশোর। পেল না বাড়িতে। তখনও ফেরেনি।
দুটোয় আবার করল। এইবার পেল। সব কথা জানিয়ে বলল, সকালে যেন হাসপাতালে হাজির থাকে।
কিশোরের ফোন পাওয়ার পর রবিনেরও ঘুম হারাম হয়ে গেল। সে-ও ভাবতে লাগল একই কথা, কে এ রকম পাইকারী হারে মানুষ মারতে চায়?
ফারিহাও ঘুমোতে পারছে না। জেগে রয়েছে বিছানায়। কান পেতে রয়েছে। আর কিছু বলে কিনা শোনার জন্যে। যতবারই গুঙিয়ে ওঠে জুন, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে সে, জুন, কে? কৈ মুরগীতে বিষ মেশাচ্ছে বলো তো? কিন্তু জবাব দেয় না জুন।
মরার মত ঘুমিয়েছে কেবল মুসা। তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।
পরদিন সকালে জানালা দিয়ে যখন হাসপাতালের ঘরে রোদ এসে পড়েছে, তখন সেখানে পৌঁছল কিশোর আর মুসা।
প্রথমেই লক্ষ্য করল কিশোর, ফারিহাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘরে ফুলদানীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে, আর তাতে অনেক ফুল। জুনের বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে একটা স্টাফ করা মুরগী, মাথায় সোনালি মুকুট। পর্দা টেনে ঘিরে দেয়া হয়েছে জুনের বিছানা।
পর্দা টানা জায়গাটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করল কিশোর। জুন কোথায়? এখুনি ওর সঙ্গে কথা বলে রহস্যটার একটা সমাধান করে ফেলতে চায়। আর কেউ আছে?
শশশ! ঠোঁটে আঙুল রেখে কিশোরকে আস্তে কথা বলতে ইঙ্গিত করল ফারিহা। ফিসফিসিয়ে বলল শুধু, জুন ঘুমিয়ে আছে।
এই সময় ঘরে ঢুকল রবিন।
সরি। দেরি হয়ে গেল। গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছিল। পুরানো ফোক্সওয়াগনটা বিক্রি করে দিয়ে আরেকটা গাড়ি কিনেছে রবিন। লম্বা, একহারা শরীর। গায়ের কটন সোয়েটারটা খুলে গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে। কয়েক বছর আগেও সে ছিল রোগাটে, হালকা পাতলা এক কিশোর। পায়ে চোট পেয়েছিল। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ভেঙে ফেলেছিল হাড়। সেটা বড় যন্ত্রণা দিত মাঝে মাঝে। এখন সব সেরে গেছে।
অনেক বদলে গেছে রবিন। লম্বা হয়েছে। গায়ে মাংস লেগেছে। চেহারায় চাকচিক্য। ধোপদুরস্ত পোশাক পরে। চাকরি করে বার্টলেট লজের ট্যালেন্ট এজেন্সিতে। কারাতের ট্রেনিং নিচ্ছে। ওকে দেখলে কেউ এখন কল্পনাই করতে পারবে না এই রবিন মিলফোর্ডই পার্ট টাইম চাকরি করত রকি বীচের লাইব্রেরিতে, আর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকত। রকি বীচ হাই স্কুলে মেয়েমহলে রবিন এখন একটা পরিচিত প্রিয় নাম।
কোথায় আমাদের কেস? হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন। ডানা মেলে উড়ে গেল না তো চিকেন প্রিন্সেস?
কেস ওই পর্দার আড়ালে, মাথা নেড়ে পর্দাটা দেখিয়ে দিল মুসা। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারিনা আমরা।
চেষ্টা করলে কিশোর পারবে, হেসে বলল রবিন। তবে যুক্তি দেখাতে গেলে মুখ খুলবে কিনা…
খোলার অবস্থাতেই নেই এখন, নিচু গলায় বলল ফারিহা। অন্তত শান্ত তো হয়ে আছে। কাল রাতে যা করেছে না! কয়েকজন লোকও এসেছিল দেখা করতে।
রাত দুপুরে! অবাক হলো কিশোর। লাল চুলওয়ালা ওই নার্সের চোখ এড়াল কিভাবে?
শ্রাগ করল ফারিহা। রহস্যময় ব্যাপার, তাই না? কারা ওরা?
ঘণ্টায় ঘণ্টায় এসেছে চিকেন লারসেন। গোটা দুই ফ্রী কুপনও দিয়েছে আমাকে।
সবাইকেই খালি কুপন বিলাচ্ছে। আর কে এসেছে?
টম হামবার নামে একটা সুন্দর লোক। নাম জানলে কি করে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
কেন, গোয়েন্দা কি শুধু তোমরাই? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ফারিহা। জিজ্ঞেস করেছিলাম। জুনের বয়ফ্রেন্ড ছিল এক সময়। ভোর চারটের দিকে এসেছিল সে। জুনের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। যেন পাহারা দিচ্ছিল ওকে। তারপর ভোরবেলা এল আরেকজন। নাম বলল হেনা তানজামিলা। জুনের কলেজ হোস্টেলের নাকি রুমমেট সে।
হুমম, মাথা দোলাল কিশোর। ওর কথা ভুলে যেতে পারি আমরা।
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
কারণ, জুন বলেছে লোকটা খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। আর ওই টমকে নিয়েও মাথাব্যথা নেই আমার। একজন ভূতপূর্ব বয়ফ্রেন্ড লাখ লাখ লোক মারার প্ল্যান করবে বলে মনে হয় না।
প্রতিশোধ নিতে চাইলেও না?
লাখ লাখ লোকের ওপর কিসের প্রতিশোধ নেবে?
আগেই তর্ক শুরু করে দিলে, বাধা দিয়ে বলল ফারিহা। চার নম্বর রহস্যময় লোকটার কথা তো এখনও শোনাইনি। কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব খাদে নামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে।
জুনের বিছানা ঘিরে টানানো পর্দার দিকে তাকাল চারজনে। যেন শিওর হতে চাইছে, জুন জেগে গেছে কিনা। তারপর লোকটার কথা বলতে লাগল ফারিহা, চার নম্বর ভিজিটরটি একজন লোক বটে! ভীষণ বদমেজাজী। বয়েস তিরিশ মত হবে। বেশ তাগড়া শরীর। একটা আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসেছিল। আমার ওপর চোখ পড়তেই জ্যাকেটের কলার তুলে নিয়ে মুখ আড়াল করে ফেলল। হতে পারে, চেহারাটা বেশি কুৎসিত, সে জন্যেই দেখাতে চায়নি।