কার্পেট বিছানো পথ ধরে প্রায় ছুটতে ছুটতে হলঘরে ফিরে এল ওরা। দারোয়ান বসে বসে ঢুলছে। ওদের সাড়া পেয়ে চমকে জেগে গেল, পেয়েছ। তোমাদের জিনিস? জিজ্ঞেস করল সে।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন আর মুসা। জবাব দেয়ার ভারটা ওর ওপরই ছেড়ে দিতে চায়।
না, কিশোর বলল। বললেন তো এখানেই আছে, কিন্তু পেলাম না। গুদামঘরের অফিসে বললেন।
গুদামঘর? দূর, মাথা খারাপ এগুলোর! এই, ওটাকে কি গুদামের অফিস মনে, হয়েছে? তোমাদের কি কমনসেন্স বলেও কিছু নেই!
কমন সেন্স আছে আমাদের দলের চার নম্বর লোকটার, নিরীহ কণ্ঠে জবাব দিল রবিন। কিন্তু সে আজকে আসেনি।
যাও। ডানের পথটা ধরে যাও, যেটাতে কার্পেট বিছানো নেই। তিনটে লাল দরজা পেরিয়ে যাবে। তারপরেই পাবে গুদামঘর। যত্তোসব! ওদের দিকে তাকাল দারোয়ান। দরজা দেখতে কেমন সেটা জানো তো?
ও জানে, কিশোরকে দেখাল মুসা।
হলঘর থেকে বেরিয়ে কার্পেট ছাড়া পথটা ধরল ওরা। একে একে পেরিয়ে এল তিনটে লাল রঙ করা দরজা। ঢুকল বিরাট এক ঘরে। নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল যেন। একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে অসংখ্য কেমিক্যালের ড্রাম।
লেবেল পড়ে দেখ, নির্দেশ দিল কিশোর। জলদি।
কটা বাজে? ভুরু নাচাল রবিন।
প্রায় সাতটা।
নটায় সম্মেলন শুরু হবে, ভুলে গেলে চলবে না। তাড়াতাড়ি সারতে হবে আমাদের।
ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে শুরু করল তিনজনে। একটু পরেই চিৎকার করে ডাকল রবিন, অ্যাই, দেখে যাও!
ড্রামের সারির ফাঁক দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল কিশোর আর মুসা। কংক্রীটের মেঝেতে মচমচ করছে জুতো, চেষ্টা করেও শব্দ না করে পারছে না ওরা। একগাদা টিন আর কাঠের পিপার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। প্রতিটির গায়ে লেবেল লাগানোঃ ব্রোমিনেটেড সিউডোফসফেটস।
পেয়ে গেলাম, যা খুঁজছিলে, রবিন বলল কিশোরকে। এতে কি প্রমাণ হলো?
জবাব না দিয়ে লেবেলে লেখা তারিখ দেখল কিশোর। তারপর বলল, দেখ, কবে এসেছে?
পড়ে মুসা বলল, দুই মাস আগে।
কি ভাবে এল? কিশোরের প্রশ্ন। ভাল করে ইনভয়েসগুলো দেখেছি আমি। দুমাস তো দূরের কথা, গত দুই বছরেও কেনা হয়নি ব্রোমিনেটেড সিউডোফসফেট। এক আউন্সও না।… ছোট টিনও আছে। নিয়ে যাব একটা। ভেতরে আসলে কি আছে দেখা দরকার।
দেখার আর দরকার কি? বলে উঠল একটা কণ্ঠ, আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিতে পারি।
পাই করে ঘুরে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। দাঁড়িয়ে আছে ফেলিক্স আরোলা।
এভাবে মুখখামুখি হয়ে যাব, ভাবতে পারিনি, বলল সে। ভেবেছিলাম, তদন্তটা বাদই দিয়ে দেবে তোমরা। ভুল করেছি। শেষে আমার পেছনেই লাগলে।
পাথর হয়ে গেছে যেন গোয়েন্দারা।
সরি, পিস্তলটা আরেকটু সোজা করে ধরল আরোলা। খরচের খাতায় তোমাদের নাম লিখে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার।
১৫
পিস্তল উদ্যত রেখেই চট করে হাতঘড়ি দেখল আরোলা। আর বেশি সময় নেই। একটু পরেই বেভারলি হিলটনে লারসনের সম্মেলন শুরু হবে, জ্যাকেটের অন্য পকেটে হাত ঢোকাল সে।
কি করবে এখন লোকটা? ভাবছে কিশোর।
জ্যাকেটের পকেট থেকে হাতটা বের করল আরোলা। মুঠো বন্ধ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই যা করার করে ফেলব। মরার আগে খানিকটা মার্কেট রিসার্চ করতে চাও?
মানে? তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার হাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
মুঠো খুলল আরোলা। মোড়কে মোড়া ক্যানডি। খেয়ে দেখবে একটা?
না, কিশোর, খেয়ো না! হুঁশিয়ার করল মুসা, বিষ!
আরোলার দিকে তাকাল কিশোর। তারপর তার পিস্তলের দিকে, তারপর ক্যানডির দিকে এবং সবশেষে ঘড়ির দিকে। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও। খেয়ে দেখলে ক্ষতি কি? পুলিশকে জানিয়ে আসেনি। কেউ উদ্ধার করতে আসবে না ওদের।
তোমার কথার দাম দিই আমি, আরোলা বলল। বুদ্ধিমান ছেলে। অনেক কিছুই বোঝ। সেদিন পার্টিতেই বুঝেছি। তোমাকে মেরে ফেলতে হচ্ছে বলে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে আমার। খেয়ে বলো, কেমন লাগে। বলবে?
দিন। কি আর করা? এত করে যখন বলছেন…
এই তো। বলেছিলাম না, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। জীবনে যদি একটা কাজ করে যেতে না পারলে, তো জন্মই বৃথা। ওই পচা বিজ্ঞানীগুলোর মত। কেবল আবিষ্কারই করতে পারে, জিনিসের মার্কেট ভ্যালু আর বুঝতে পারে না কোনদিন।
মনে হচ্ছে আপনি খুব বোঝেন, লোকটার কথা সহ্য করতে পারছে না রবিন। ওকে এত চাপাচাপি করছেন কেন? আপনি খেয়ে টেস্ট করে নিলেই পারেন…
দেখ ছেলে, বেশি ফরফর করবে না! হঠাৎ রেগে গেল আরোলা। তোমার কপাল ভাল যে তোমার বন্ধুর স্বাদ যাচাই করার ক্ষমতা আছে। বাঁচিয়ে রেখেছি সে কারণেই, সকলকে, নইলে এতক্ষণে লাশ হয়ে যেতে, নিজেকে শান্ত করার জন্যে জোরে জোরে দুবার শ্বাস টানল সে। বিড়বিড় করল, লাশের গন্ধও আমার ভাল লাগে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। মনে হচ্ছে, আরোলার মাথায় গোলমাল আছে। কি জানি, গত কয়েক বছরে হয়তো অনেক মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে সে, খাবারে মালটিসরবিটেন মিশিয়ে। আর অপরাধ বোধের কারণেই চাপ পড়েছে মাথায়, গেছে গড়বড় হয়ে।
দিন, একটা ক্যানডি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। খেয়ে দেখি। তবে এক শর্তে। আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
মাথা ঝাকিয়ে সায় জানাল আরোলা। একটা ক্যানডি দিল কিশোরের হাতে।
মুখে ফেলল কিশোর। তিনটে স্বাদ। লেবু-আসল লেবুর গন্ধ পাচ্ছি, নকল। আর রয়েছে ম্যারাং এবং গ্রাহাম ক্র্যাকারের সর। তিনটে মিলিয়ে লেমন ম্যারাং পাই।