সব সময় লাগি না, কৈফিয়তের সুরে বলল কিশোর।
পলের ব্যবস্থা করে চিকেন লারসেনের বাড়ি রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। ওখানে ওদের অপেক্ষায় আছে জুন আর ফারিহা। লারসেন বাড়ি নেই। ফিরতে দেরি হতে পারে।
সদর দরজায় বেল শুনে খুলেই তিন গোয়েন্দাকে দেখে একসঙ্গে বলে উঠল দুজনে, পেয়েছ?।
নীরবে ব্রিফকেসটা তুলে ধরল কিশোর। কি করে এসেছে, তার প্রমাণ দিতে চাইল যেন।
হাসল জুন। ওদেরকে নিয়ে এল বসার ঘরে।
কাচের কফি টেবিলে ব্রিফকেসটা রাখল কিশোর।
অস্থির হাতে সামনের খোপের চেনটা তুলে ভেতর থেকে মরক্কো লেদারে বাঁধাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকটা বের করল জুন। কাঁপা হাতে খুলল শুক্রবারের সেই পাতাটা, যেদিন অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। যেদিনকার ঘটনা স্মৃতি থেকে মুছে গেছে।
এই যে, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেছে ওর।
পুরো একটা মিনিট পাতাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, কিছুই নেই। কেবল আর অ্যান্ড ডি।
রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, কিশোর বলল। ডন বারোজের ডিপার্টমেন্ট, তাই না? ওর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলে কেন? কি আলোচনা করেছিলে?
কাজ শেখার চেষ্টা করছি আমি। সব বিভাগেই কাটিয়েছি একদিন করে। এর বেশি আর কিছু মনে করতে পারছি না।
ব্রিফকেসের ভেতরে কি আছে দেখলে হয়তো মনে করতে পারবে, আশা করল কিশোর।
ভেতর থেকে একটা তিন রিঙের বাইন্ডার বের করল। প্রায় দুশো ফটোকপি করা কাগজ রয়েছে তাতে। কয়েক মিনিট কাগজগুলো ওল্টাল, তারপর রেখে দিল টেবিলে। চিনতেই পারছি না! ওগুলো দেখে স্মৃতি ফেরত আনার চেষ্টা করছিল সে, ব্যর্থ হয়েছে। ভীষণ হতাশ হয়েছে।
আমি দেখি? অসুবিধে আছে? নোটবুকটার দিকে হাত বাড়াল কিশোর। পয়লা পাতাতেই ডন বারোজের নাম। দ্রুত রিপোর্টটা পড়তে শুরু করল সে। কয়েক মিনিট নীরবে পড়ার পর মুখ তুলল। বলল, সেই শুক্রবারে কি ঘটেছিল বোধহয় বুঝতে পারছি। ডন বারোজের লেখা একটা রিপোর্টের কপি এটা। মালটিসরবিটেন নামে খাবারে মেশানোর একটা উপাদান সম্পর্কে। কয়েক বছর আগে জিনিসটা আবিষ্কার করেছিল ডন। বলছে, মালটিসরবিটেন মেশালে খাবারের স্বাদ অনেক বেড়ে যায়, তবে একটা অসুবিধেও করে। এতই সুস্বাদু হয় খাবার, নেশাগ্রস্ত করে ফেলে মানুষকে।
ভাল খাবার তো লোভী করবেই মানুষকে, রবিন বলল। তাতে অসুবিধেটা কোথায়?
অসুবিধেটা? মালটিসরবিটেনের বেলায় আছে। এফ ডি এ, অর্থাৎ ফেডারেল ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এই উপাদানটা পরীক্ষা করেছিল। নতুন যে কোন খাবার আর ড্রাগ পরীক্ষা করে দেখা ওদের দায়িত্ব। উনাকে মালটিসরবিটেন বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয়নি ওরা। কারণ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ক্যারসিনোজেন হতে পারে ওই জিনিসে।
কি জেন? মুখ বাঁকাল মুসা।
ক্যারসিনোজেন। বুঝিয়ে দিল রবিন, ক্যানসার হয় ওতে।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। বলতে থাকল, দুর্ঘটনার দিন শুক্রবারে তুমি ডনের সঙ্গে দেখা করেছ। ওই রিপোর্টের কপি পেয়ে গেছ, কাগজটায় টোকা দিল সে। সে দেয়নি। আমার বিশ্বাস, ওর অফিসে ঢুকে কোনভাবে দেখে ফেলেছিলে কাগজটা। অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে রাতের বেলা। কাজেই অনুমান করছি, বিকেলের দিকে পেয়েছ তুমি। পড়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিলে।
জুনের দিকে তাকাল কিশোর। সবকথা মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে যেন। বলল, এতই ঘাবড়ে গিয়েছিলে, কাগজটা নিয়েই ছুটে বেরোলে ডনের অফিস থেকে দেখে ফেলেছিল সে। তাড়া করেছিল তোমাকে। তোমার গাড়িতে গিয়ে উঠলে। নিজের গাড়িতে করে তোমাকে অনুসরণ করল সে। দুর্ঘটনার জায়গায় আরেক সেট চাকার দাগ যে পাওয়া গেছে সেটা ওরই গাড়ির।
মুসা প্রশ্ন করল, ওই একটা রিপোর্ট অতটা উত্তেজিত করবে কেন জুনকে?
করবেই তো, হাসল কিশোর। জুন হয়তো বুঝে ফেলেছিল, চিকেন লারসেনের নতুন খাবার ড্রিপিং চিকেনে ওই মালটিসরবিটেন মিশিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডন।
কথাটা সবাইকে হজম করার সুযোগ দিল গোয়েন্দাপ্রধান। তারপর জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বুঝে ফেলেছিলে, ডন, কিংবা আরোলা, কিংবা তোমার বাবা ইচ্ছে করেই জেনেশুনে ওই বিষ মেশাতে চলেছেন খাবারে। ড্রিপিং চিকেনে। ওই বিষের ক্রিয়া টের পেতে পেতে রোগীর কয়েক বছর লেগে যাবে। কাজেই সহজে ধরা পড়বে না যে মেশাবে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ লোক নিয়মিত খেয়ে যাবে মালটিসরবিটেন, বুঝতেই পারবে না ক্যানসারে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে ওরা। যখন বুঝবে, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। হয়তো তখনও বুঝবে না কিসের কারণে হয়েছে তাদের ওই মরণ ব্যাধি।
ঠোঁট কাঁপছে জুনের। প্রায় চিৎকার করে বলল, অসম্ভব! আমার বাবা ওরকম পাষন্ড হতেই পারে না!
আমরা এখনও জানি না সেটা। প্রমাণ করতে হবে যে তিনি এতে জড়িত নেই। আর সেটা করায় আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে তোমাকে।
মনে মনে ইতিমধ্যেই কিছু একটা করার পরিকল্পনা করে ফেলেছে কিশোর, বুঝতে পারল তার দুই সহকারী। রবিন জিজ্ঞেস করল, কি করতে চাইছ তুমি?
জানতে চাই, ড্রিপিং চিকেনে মালটিসরবিটেন মেশানোর ব্যাপারটা জানেন কিনা মিস্টার লারসেন। কি করে জানব, কেউ কোন পরামর্শ দিতে পারো?
পারি, জুন বলল। বাবা তার সমস্ত কাজের ফিরিস্তি কাগজে লিখে অফিসের আলমারিতে রেখে দেয়।