মোটর বন্ধ করে দিয়ে, অপারেটরের খাচার চারপাশে ছড়ানো হলুদ রং করা প্লাটফর্মে বেরিয়ে এল পল। নিচে তাকিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে।
গাড়িটা জুন মিলারের? জানতে চাইল কিশোর।
হ্যাঁ। কেন?
একটু দেখতে চাই।
লাভ হবে না। একটা স্পেয়ারও পাবে না। সব গেছে।
তবু। বেশিক্ষণ লাগবে না।
বেশ, ওদিকটায় যাও, নামিয়ে দিচ্ছি, পড়ে থাকা অনেকগুলো বাতিল ট্রাকের পাশের খালি জায়গা দেখাল পল।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে সেদিকে এগোল কিশোর। পিছে পিছে চলল রবিন আর মুসা।
আবার চালু হলো ক্রেনের ইঞ্জিন। কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখল কিশোর, এপাশ ওপাশ দুলছে গাড়িটা। তারপর বিরাট একটা চক্র সৃষ্টি করে যেন এগোতে শুরু করল।
অত ওপর থেকে যদি কোনভাবে মাটিতে খসে পড়ে, মুসা বলল। ভর্তা হয়ে যাবে।
প্রায় মাথার ওপর চলে এসেছে গাড়িটা। সরে গেল ওরা। কিন্তু গাড়িটা চলল ওদের সঙ্গে, ওপরে ওপরে, যেন অনুসরণ করতে চাইছে। বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দুলছে।
মজা করছে নাকি? ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।
না, মজা নয়! আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ওই দেখো!
ক্রেনের গোড়ায় পড়ে থাকতে দেখা গেল পলকে। পেট চেপে ধরেছে, বাঁকা হয়ে গেছে ব্যথায়। ক্রেন অপারেটরের বুদে ঢুকে পড়েছে অন্য কেউ, সে-ই চালাচ্ছে। তিন গোয়েন্দার মাথার ওপরে চলে এসেছে গাড়িটা।
কে চালাচ্ছে? কিশোরের প্রশ্ন।
কিন্তু জবাব পেল না। দেবেই বা কে? গোল, চ্যাপ্টা একটা বড় চুম্বকের সাহায্যে তোলা হয় গাড়ি। ইলেকট্রোম্যাগনেট। অফ করে দেয়া হলো সুইচ।
কিন্তু জবাব খোঁজার সময় নেই। গাড়িটা এখন একেবারে মাথার ওপর। আচমকা ছেড়ে দিল ওটাকে ক্রেন। পড়তে আরম্ভ করল তিন হাজার পাউন্ড ওজনের গাড়িটা।
১৩
তিন দিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বিকট শব্দে মাটিতে পড়ল গাড়ি।
ভাঙা কতগুলো গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা। দেখছে, শূন্যে দুলছে ভারি ইলেকট্রোম্যাগনেট, যে চুম্বকটার সাহায্যে গাড়ি তোলা হয়। ওটার এক বাড়ি খেলেই মরে যাবে মানুষ। বোঝাই গেছে, অপারেটরের বুদে যে রয়েছে এখন সে ওরকম কিছু ঘটানোরই চেষ্টায় আছে।
বিশাল চুম্বকটার দুলুনি বন্ধ হলে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসা। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ক্রেনের বুদে কে আছে।
আগেই বোঝা উচিত ছিল, ফিসফিস করে বলল সে। আমাদের মিস্টার এক্স!
পুরানো গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে। দেখল, ক্রেনের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে লোকটা। গায়ে আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট। লাফিয়ে নামল পলের কাছে। তার ঘাড়ে এক রদ্দা মেরে তাকে চিৎ করে দিল আবার, যাতে কিছুক্ষণ আর না উঠতে পারে।
এদিকেই আসছে, দুই সহকারীকে পিছিয়ে যেতে ইশারা করল মুসা। আবার গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তিনজনে। এমনভাবে থাকার চেষ্টা করল, লোকটা দেখতে না পায়।
জুনের গাড়িটা দেখতেই এসেছে হয়তো, কিশোর বলল। আমাদের মত।
কানে এল কাচ ভাঙার শব্দ। ধোঁয়ার গন্ধ নাকে এলো আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না মুসা। মুখ বের করে তাকাল। দেখল, দ্বিতীয় মলোটভ ককটেলটা ছুঁড়ছে মিস্টার এক্স। বোতল ভাঙার শব্দই তখন কানে এসেছে।
সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে ফেলছে! হতাশ কণ্ঠে বলল মুসা।
তাহলে এই ব্যাপার, কিশোর বলল। লোকটা চায় না, গাড়িতে যা আছে আমরা দেখি।
পেট্রল আছে কিনা কে জানে! তাহলে বোমার মত ফাটবে!
আগুন ধরে যেতেই দৌড় দিল মিস্টার এক্স। ইয়ার্ডের গেটের কাছে রাখা তার পোরশেতে গিয়ে উঠল। পিছু নিতে চাইল মুসা। হাত ধরে তাকে টেনে আটকাল কিশোর আর রবিন।
ওকে ধরার দরকার নেই, রবিন বলল। গাড়ির ট্রাঙ্ক দেখতে হবে! যে কাজে এসেছি!
কুইক! তাড়া দিল কিশোর। গাড়িটা পুড়ে যাওয়ার আগেই… পুড়বে তো না, ফাটবে!
গাড়িটার দিকে আরেকবার তাকাল মুসা। তারপর দিল দৌড়। পুরানো জঞ্জালের মধ্যে খুঁজতে আরম্ভ করল। জিনিসটা খুঁজে বের করতে বেশিক্ষণ লাগল না। একটা শাবল। তারপর ছুটল জুনের তোবড়ানো মাসট্যাঙের দিকে। ভেতরের গদিটদি অনেকখানিই পুড়ে গেছে ইতিমধ্যে। পেছনের দিকে এগোচ্ছে আগুন, যেখানে পেট্রল ট্যাংকটা রয়েছে।
শাবল দিয়ে ট্রাঙ্ক খোলার চেষ্টা শুরু করল মুসা। ঘামে ভিজে গেছে কপাল। একটা চোখ সারাক্ষণ রেখেছে আগুনের ওপর। অবশেষ খুলে গেল ট্রাঙ্ক।
পেয়েছি! আনন্দে চিৎকার করে উঠল সে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল চামড়ার ব্রিফকেসটা। হাতে তুলে নেড়ে দেখাল কিশোর আর রবিনকে। জলদি ভাগ! ফাটবে এখুনি! ট্যাংকের কাছে পৌঁছে গেছে আগুন।
কিন্তু নড়ল না কিশোর। হাসছে। বলল, গাড়ি ভাঙার আগে পেট্রল বের করে নেয়া হয়, যাতে কোনরকম দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। জ্বলবে গাড়িটা, কিন্তু ফাটবে না।
আগে অকথা বলেনি কেন? অভিযোগের সুরে বলল মুসা। তাহলে অত তাড়াহুড়া করতাম না…।
সে জন্যেই বলিনি। ওই তাড়াহুড়াটা না করলে হয়তো সময়মত খুলতে পারতে না ট্রাঙ্কটা। ঠেকায় পড়লেই কেবল মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে।
তুমি যে একটা কি…! জ্বলন্ত চোখে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকাল মুসা।
ফোন করে অ্যামবুলেন্স ডাকা হলো। তারপর পলকে দেখতে চলল তিন গোয়েন্দা, ওর অবস্থা কতটা খারাপ।
তোমরা গোয়েন্দা, শুনেছি, পল বলল। কিন্তু জানতাম না সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও লাগতে যাও।