তো?
তো, আমাদেরকেও তাড়াতাড়ি রহস্যটা ভেদ করতে হবে। তিনজনকে সন্দেহ করি আমরা আপাতত। ওদের নিয়েই আলোচনা করা যাক।
করো। মুসা জানে, আলোচনা এবং বিশ্লেষণ দুটোই কিশোর করবে, সে শ্রোতা মাত্র।
প্রথমেই ধরা যাক, কেন অপরাধ করে লোকে। কোন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। ধরলাম, এ ক্ষেত্রে চিকেন লারসেন কাজটা করতে চাইছেন। তার পক্ষে বিষ মেশানো খুব সহজ। মুরগীর খাবারে কিছু মিশিয়ে দিতে পারেন। কিংবা মুরগী দিয়ে খাবার তৈরি করার সময় মাংসে মেশাতে পারেন।
মাংস মুখে পুরতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেল মুসা। তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। তারপর রেখে দিল প্লেটে।
কিন্তু চিকেন লারসেনের উদ্দেশ্য কি? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। মোটিভ?
কি আর? পাগল!
এতটাই পাগল, যে লাখ লাখ মানুষকে মারবেন? নিজের মেয়েকে অ্যাক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলতে চাইবেন?
আমি কি করে জানব? কিন্তু গলা কেটে আর কে মুরগী পাঠাতে যাবে আমাদের কাছে?
যে কেউ পারে। বাজার থেকে কিনে নিলেই হলো। হেনরি অগাসটাসের কথা ধরতে পারি আমরা। তার মোটিভ খুব জোরাল। লারসেনের বদনাম করে দিয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। নিজের ব্যবসা বাড়ানোর জন্যে। পিটালুমায় মুরগীর ঘরে ঢুকে আজ একটা কথা বলেছিল, খেয়াল করেছ? মুরগীর খাবারের ব্যাপারটা সে নিজে দেখবে। হতে পারে, খাবারে বিষ মেশানোর কথাই বলেছে। এমন কিছু, যেটা মুরগীর তেমন ক্ষতি না করলেও মানুষের করবে। খামারটা না কিনেও যে কেউ করতে পারে কাজটা। যে কেউ ঢুকতে পারে। ইচ্ছে করলে আমরাও মিশিয়ে দিতে পারতাম। কেউ বাধা দেয়ার ছিল না।
বেশ, দুজন গেল। আরেকজন কে?
মিস্টর এক্স। যাকে আমরা চিনিই না এখনও।
সন্দেহভাজনদের নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করল ওরা। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল। গাড়ির দিকে এগোল।
স্যান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। জায়গাটা কুয়াশার জন্যে বিখ্যাত। ইতিমধ্যেই নামতে আরম্ভ করেছে। ঘিরে ফেলেছে গোল্ডেন গেট ব্রিজকে। চোখে পড়ছে কেবল ব্রিজের দুটো টাওয়ারের ওপরের অংশ আর একেবারে নিচে চলমান যানবাহন। মাঝখানটা ফাঁকা, কুয়াশার জন্যে চোখে পড়ে না, যেন কিছুই নেই ওখানটায়।
স্যান ফ্রান্সিসকোর সাতটা পাহাড়েরও একই অবস্থা। চূড়া আর গোড়ার উপত্যকা চোখে পড়ে, মাঝখানটা অদৃশ্য। আরও অনেকবার দেখেছে মুসা। তার কাছে ব্যাপারটা একটা বিরাট রহস্য। এরকম কেন হয়? মধ্যগ্রীষ্মের প্রতি রাতেই ঘটে এই একই কান্ড।
রেডিও অন করে দিল সে। রক মিউজিক বাজছে একটা স্টেশনে।
বিমান বন্দর থেকে মাইল পনেরো দূরে থাকতে অস্বস্তিতে পড়ল। বার বার রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাচ্ছে। বলল, পেছনে দেখো। একটা লাল রঙের ক্যাভেলিয়ার।
তাতে কি? কিশোরের প্রশ্ন।
মনে হয় আমাদের অনুসরণ করছে।
কে করবে? ভাবতে লাগল কিশোর। ওরা যে স্যান ফ্রান্সিসকোয় এসেছে একথা কেউ জানে না। কিন্তু মুসার সন্দেহ গেল না কিছুতেই। অবশেষে কিশোর বলল, রাখ তো। দেখি।
গতি কমাল মুসা। দ্রুত এগিয়ে এল লাল গাড়িটা। আরেকটু হলেই বাম্পারে বাম্পারে লেগে যাবে। ভেতরে কে আছে দেখার চেষ্টা করল কিশোর। পারল না। হেডলাইটের আলো এসে পড়ে চোখে। ডানে কাটছে গাড়িটা। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। জানালা নামিয়ে দিল কিশোর। ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। লোকটা। একেবারে মুখোমুখি।
অস্ফুট একটা শব্দ করে প্রায় ছিটকে জানালার কাছ থেকে সরে এল কিশোর। মিস্টার এক্স! সেই আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট। মুখে গর্ত গর্ত দাগ। গুটি বসন্ত হলে কিংবা ব্রণের ক্ষত হলে যেমন হয় অনেকটা সে রকম। শীতল একটা হাসি যেন জমাট বেঁধে রয়েছে ঠোঁটে। সাপের চোখের মত ঠান্ডা চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, খুনীর চোখের দিকে চেয়ে আছে।
চলো! পালাও! চিৎকার করে মুসাকে বলল কিশোর।
কেন চিৎকার করল কিশোর, দেখার জন্যে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে দেখতে চাইল মুসা। হেসে উঠল মিস্টার এক্স। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গুঁতো মারতে এল ওদের গাড়িকে।
কিন্তু ততক্ষণে গ্যাস প্যাডালে চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে মুসা। খেপা ঘোড়ার মত, লাফিয়ে আগে বাড়ল ওদের গাড়ি।
অনুসরণ নয়, রিয়ারভিউ মিররে চট করে একবার দেখে নিয়ে বলল সে, আমাদেরকে রাস্তার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে এসেছে ব্যাটা!
ঠিক পেছনে লেগে রইল মিস্টার এক্স। সামনে গাড়িটাড়ি কিছু পড়লে, কিংবা অন্য কোন কারণে মুসা গতি কমাতে বাধ্য হলে শাঁ করে পাশের লেনে সরে যায় লাল গাড়িটা, ধেয়ে এসে ভ্রাম করে বাড়ি লাগিয়ে দেয়। তবে এখনও বডিতে লাগাতে পারেনি, কেবল বাম্পারে লাগিয়েছে।
বেরোও, কিশোর বলল। ওকে আটকে রেখে বেরিয়ে যাও কোনখান দিয়ে। খসাতেই হবে!
দ্রুত মহাসড়ক থেকে নেমে পড়ল মুসা। লাল গাড়িটাও নামল। মুসা যত জোরেই চালাক না কেন, ঠিক পেছনে লেগে থাকে। আর সুযোগ পেলেই এসে গুতো মারে। কিছুই করার নেই আর, চালানো ছাড়া। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ?
এই অন্ধকারে কি করবে?
মুসার একবার মনে হলো, রুখে দাঁড়ায়। সে-ও ধাক্কা মারে। কিন্তু ওই গাড়িটা অনেক বেশি শক্ত, ওটার সঙ্গে পারবে না। পালিয়ে বাঁচা ছাড়া আর কোন পথ নেই।
পাহাড়ের কোলে একটা আবাসিক এলাকায় চলে এল ওরা। নামেই আবাসিক, বাড়িঘরগুলো এত দূরে দূরে, জনবসতিশূন্যই মনে হয়। হঠাৎ তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে পাহাড়ের ওপর দিকে উঠতে শুরু করল মুসা। ভ্রাম করে গুঁতো লাগল পেছনে। একটা নির্দেশকে দেখা গেল স্যান ফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট টুইন পিকসের দিকে চলেছে ওরা। পর্বতের চূড়াদুটোর ওপরে দাঁড়িয়ে নিচের চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। সুন্দর উপত্যকা, জলরাশি, শহরের আলো, সব দেখা যায়।