মিনিটখানেক পরে ঢুকলেন লারসেন। পরনে লাল জগিং স্যুট, সাদা এবং নীল স্ট্রাইপ দেয়া। ওপরের ঠোঁট আর নাক জুড়ে আটকানো রয়েছে রবারের তৈরি একটা মুরগীর ঠোঁট। হাতে রূপার তৈরি বড় একটা অ্যানটিকের ট্রে, রূপার ঢাকনা দেয়া। তীব্র আলোয় এসে সামান্য কুঁকড়ে গিয়ে বুদের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন।
আমার লোক আছে? ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আছে, মিস্টার লারসেন, পরিচালক বললেন। সুইভেল চেয়ারে বসেই ঘুরে তাকালেন কিশোরের দিকে। চিকেন লারসেনের অফিশিয়াল টেন ইয়ার অ্যানিভারসারি টি-শার্ট গায়ে দেয়ানো হয়েছে তাকে। শার্টে একটা মুরগীর ছবি আঁকা, মাথার জায়গায় মুরগীর মাথার পরিবর্তে আঁকা হয়েছে লারসেনের মুখ।
ডন বলেছে, কিশোরকে বললেন লারসেন। ড্রিপিং চিকেনের স্যাম্পল খেয়ে খুব খুশি হয়েছে। আজ সবার জন্যেই প্রচুর পরিমাণে নিয়ে আসা হয়েছে।
ফিসফিস করে মুসা বলল কিশোরের কানে, অত ভাল প্যান্টটা পরে আসা উচিত হয়নি আজ।
আরাম করে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিলেন লারসেন।
পরিচালক ঘোষণা করলেন, দয়া করে চুপ করুন সবাই। ড্রিপিং চিকেন। টেক ওয়ান!
ক্যামেরার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন টিভি দর্শকদের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন লারসেন।
বন্ধুরা, বলছেন তিনি। আমি, আপনাদের প্রিয় চিকেন লারসেন বলছি। আপনারা জানেন, অহেতুক আপনাদের সামনে হাজির হই না আমি। হই তখনই, এখন আপনাদের পকেট খালি করে আমার পকেট ভরানোর কোন একটা উপায় বের করে ফেলি। বিশ্বাস করুন, এই বার আগের চেয়ে অনেক বেশি খসাব আমি, কিছুতেই ধরে রাখতে পারবেন না। চাকা আবিষ্কারের সময় আমি সেখানে হাজির ছিলাম না। পেনিসিলিন আবিষ্কারের সময় ছিলাম না। এমনকি পেপার ক্লিপ জাতীয় জিনিসগুলো যখন আবিষ্কার হয়, তখনও সেখানে হাজির ছিলাম না। ইতিহাসের অইসব বিস্ময়কর মুহূর্তগুলোতে আমার কোন প্রয়োজন পড়েনি কিংবা হয়তো প্রয়োজন হয়েছিল, খবরও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই খবর আমাকে বলতে ভুলে গেছে আমার সেক্রেটারি। আর এই সন্দেহেই আমি তাকে চাকরি থেকে বিদেয় করে দিয়েছি। হাহ হাহ হা! তবে আজকে আমি আর শুধু ইতিহাস তৈরি করতেই যাচ্ছি না, ইতিহাসকে খেয়ে ফেলতে চলেছি।
রূপার ট্রের ওপর থেকে ঢাকনা সরালেন লারসেন। ধোঁয়া উঠতে লাগল স্তূপ করে রাখা ড্রিপিং চিকেন থেকে। খাবারের চেহারা দেখেই উহ আহ শুরু করে দিন প্রোডাকশন বুদের লোকেরা।
একটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে মুখের কাছে নিয়ে গেলেন লারসেন। এগিয়ে গেল ক্যামেরা, কাছে থেকে ছবি তোলার জন্যে। ঢোক গিলল তিন গোয়েন্দা সত্যিই কি তিনি খাবেন?
সেই সভ্যতার গোড়া থেকেই যে কাজ করার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ পারেনি, সেটাই সফল করেছি আমি। সৃষ্টি করেছি ড্রিপিং চিকেন। প্রতি কামড় খাবার রসময় করে তুলবে রসনাকে। আরও ব্যাপার আছে। প্রতিটি স্যান্ডউইচে ভেতরে একটা বিশেষ জিনিস ভরে দিতে বলেছি আমার রাঁধুনিকে। এমন কিছু, যা লোকে কল্পনাই করতে পারবে না। দেয়া হয়েছে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, দেখতে চাইছি, এখনই দোকানে ছুটছেন কেনার জন্যে। কিনে গপগপ করে গিলতে থাকুন। এই ভাবে…
বলেই হাঁ করে বিরাট এক কামড় বসালেন লারসেন। বড় একটুকরো স্যান্ডউইচ কেটে নিয়ে চিবাতে লাগলেন। রঙিন রস গড়াতে শুরু করল ঠোঁটের দু কোণ থেকে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দরাজ হাসি হাসলেন।
কাট! চিৎকার করে আদেশ দিলেন পরিচালক। দারুণ হয়েছে!
কয়েকটা আলোর উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেয়া হলো। উত্তেজনা কমে গেল বুদের লোকের। ফারিহা বলল গোয়েন্দাদেরকে, ঐতিহাসিক একটা লেকচার দিলে লারসেন!
কিন্তু ওর কথায় কান নেই তিন গোয়েন্দার। স্টুডিওর কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে লারসেনের দিকে। চিবানো ড্রিপিং চিকেন গেলেননি তিনি মুখ থেকে বের করে ফেলে দিলেন ওয়েস্ট বাস্কেটে।
মনে হলো, যেন তিনি জানেন বিষ রয়েছে ওই খাবারে। মানুষের শরীরে জন্যে ক্ষতিকর, মারাত্মক বিষ।
৯
টেলিভিশনের ব্যাপারে ভালই জ্ঞান আছে কিশোরের। বুঝতে পারছে, ডিপি চিকেনের শুটিং শেষ হয়নি। তাই বলে এটাও ভাবেনি, আরও পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলবে। আরও বিশবার অভিনয় করলেন লারসেন। প্রতিবারেই বড় করে কামড় বসালেন স্যান্ডউইচে, প্রতিবারেই পরিচালক কাট বলার পর মুখ থেকে বের করে ফেলে দিলেন।
সব শেষ হওয়ার পর লারসেন চিৎকার করে বললেন, এসো, এবার পার্টি হোক! উপস্থিত সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন ড্রিপিং চিকেন চেখে দেখার জন্যে। একপাশে একটা মাইক্রোওয়েভ রাখা আছে। খাবার গরম করে নেয়ার জন্যে। টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে বুদে যত ধরনের লোক আছে সবাই ছুটে এল ওই খাবার খাওয়ার জন্যে। তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।
কেউ মারা গেল না। কারও পেট ব্যথা করল না, পেট চেপে ধরল না কেউ। বিষক্রিয়ার কোন লক্ষণই দেখল না। এক ধরনের গোঙানিই শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে, আহ উহ করছে লোকে, সেটা খাবারের স্বাদের কারণে।
ধীরে ধীরে ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেল কিশোর, যেখানে রূপার ট্রেতে রাখা আছে ড্রিপিং চিকেন। আর মাত্র দুটো স্যান্ডউইচ বাকি। একটা নেয়ার জন্যে সবে হাত বাড়িয়েছে, কাঁধের ওপর দিয়ে রবিন বলল ফিসফিসিয়ে, কে কে স্যান্ডউইচ নেয়নি, লক্ষ্য করেছ?