একসঙ্গে সবগুলো মুখ ঘুরে গেল কিশোরের দিকে। চিকেন লারসেন সহ।
আমার মনে আছে, আবার বলল কিশোর। সে বছরই আপনি একটা ফোয়ারা বানিয়েছিলেন। তার পাশে হোস পাইপের ব্যবস্থা করেছিলেন। আপনার রান্না করা মুরগী খাওয়ার পর বাচ্চারা যাতে পানি ছিটিয়ে মজা করতে পারে।
তুমি তো একটা জিনিয়াস হে! এগিয়ে এলেন লারসেন। ভালুকের থাবার মত বিশাল থাবায় চেপে ধরলেন কিশোরের হাত।
ঝাঁকাতে গিয়ে কিশোরের মনে হলো, ওই হাত নাড়ার সাধ্য তার নেই।
তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভাল, বুঝতে পারছি, লারসেন বললেন। এক কাজ করো না। আমি কি কি করেছি, সেই ইতিহাসগুলো তুমিই বলে দাও। সবাই শুনুক। আমিও শুনি। নিজের পুরানো দিনের কথা শুনতে ভালই লাগে মানুষের।
বেশ, ছোট্ট কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। উনিশশো ছিয়াশি সালে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অয়েলে চিনি মিশিয়েছিলেন আপনি। আপনার রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে লম্বা একটা মুরগীর মিছিল পার করিয়েছিলেন। মুরগীগুলোর গলায় ঝুলছিল লাল রঙের মলাটের টুকরো। তাতে সোনালি অক্ষরে লেখা ছিলঃ চিকেন লারসেনের জন্যে আমি সব করতে রাজি।
নাহ, এই ছেলেটাকে আমি পালকপুত্র করে নেব! জনতার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করলেন লারসেন। চেঁচিয়ে ডাকলেন মেয়েকে, জুন, তোর একটা নতুন ভাই জোগাড় করেছি!
মুরগীর ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনায় মগ্ন কিশোর আর লারসেন, মুসা আর ফারিহা তখন জুনের সঙ্গে আলাপ করছে। পুলের নিচু ডাইভিং বোর্ডের ওপাশে রয়েছে ওরা।
দারুণ পার্টি দিয়েছ, ফারিহা বলল। এত্তো লোক! কারা ওরা?
জানি না। কোথেকে দাওয়াত করে এনেছে বাবা, বাবাই জানে, জুতো খুলে পানিতে পা ডোবাল জুন। যাকে পায় তাকেই দাওয়াত করে বসে বাবা, কিংবা ফ্রী কুপন দিয়ে দেয়, স্বভাবই এরকম। আমি হয়েছি ঠিক উল্টো। ভালমত না জেনে না বুঝে কিছু করতে পারি না। এই স্মৃতিবিভ্রমের ব্যাপারটা খেপিয়ে দিচ্ছে আমাকে। কেবলই মনে হয়, কেন মনে করতে পারি না! লোকে এসে সান্ত্বনা দিয়ে বলেঃ তুমি ভাল হওয়ায় খুশি হয়েছি। যারা বলে তাদেরকে চিনতে পারি না। অসহ্য লাগতে থাকে!
লম্বা একটা লোককে দেখেছ কখনও, মনে পড়ে? মুসা জিজ্ঞেস করল। কুৎসিত চেহারা। আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট পরে?
মাথা নাড়ল জুন। নাহ। কেন?
তোমাকে ওর কথা বলতেই ভুলে গেছি, ফারিহা বলল। আমরা ওর নাম রেখেছি মিস্টার এক্স। যে রাতে তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়, সে রাতে হাসপাতালে তোমার ঘরে এসেছিল সে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, লোকটা তোমার অপরিচিত হওয়ার কারণ আছে। আর একটিবারও আসেনি সে এরপর।
ভুরু কুঁচকে গেল জুনের। চোখে ভয় দেখা দিল বলে মনে হলো মুসার।
থাক অসব কথা, হাত নেড়ে বলল সে। তোমার গাড়িটার কি অবস্থা, জুন? আমি ইঞ্জিনের কাজ জানি। চাইলে আমার সাহায্য নিতে পারো।
আমার গাড়ি? সোজা ওটাকে জাংকইয়ার্ডে পাঠিয়ে দিয়েছে বাবা। একবার চোখের দেখাও দেখতে দেয়নি আর আমাকে। তার ধারণা, অপয়া গাড়ি।
অ্যাক্সিডেন্টের দিন যা ঘটেছিল কিছুই মনে করতে পারছ না? ফারিহা জিজ্ঞেস করল।
না। দিন গেলে হয়তো মনে পড়বে। আগামী হপ্তায়ও পড়তে পারে।
সেদিন বিকেলে হেডকোয়ার্টারে ফিরে কিশোরের ওয়ার্কশপে আলোচনা করতে বসল তিন গোয়েন্দা। মুসা আর রবিন পিজ্জা চিবুচ্ছে। কিশোর এক টুকরো ফুটকেক নিয়ে এসেছে ফ্রিজ থেকে, মেরিচাচীর তৈরি। তাতে পেটের ক্ষতি হবে না।
হাসপাতালে ঘন ঘন ফোন না হয় করলই ফেলিক্স আরোলা, মুসা বলল একসময়। তাতে কি?
ওর বলার ধরনটাই পছন্দ হয় না আমার, সুইভেল চেয়ারে হেলান দিল কিশোর। সেজন্যেই সন্দেহটা জেগেছে।
বেশ, তার ব্যাপারে খোঁজখবর নেব আমরা, রবিন বলল। লম্বা চুমুক দিল। কোকাকোলার বোতলে। তো, কাল তাহলে যাচ্ছ চিকেন লারসেনের ওখানে?
যেতে তো বলেই দিয়েছে, কিশোর বলল। পালকপুত্রই প্রায় করে নিয়েছে পার্টিতে। আমিও যতটা সম্ভব খাতির জমিয়েছি। কায়দা করে অনুমতি আদায় করে নিয়েছি, তার রিসার্চ ল্যাব আর মেইন অফিসে ঢোকার।
কি পারে বলে মনে হয়? মুসার প্রশ্ন। বিষের বাক্স? আঙুলে লেগে থাকা মাখন চেটে খেতে লাগল সে।
কি পাব জানি না। সব নির্ভর করে কতটা গভীরে ঢোকার সুযোগ পাব আমরা, কতখানি দেখতে পারব, তার ওপর।
যেতে পারলে খুবই ভাল হত, রবিন আফসোস করল। কিন্তু…
পারছ না, এই তো? ট্যালেন্ট এজেন্সিতে যেতে হবে। তা যাও।
আজকাল আর আমাকে দিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে না তিন গোয়েন্দার, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। ভাবছি এজেন্সির চাকরিটা ছেড়েই দেব…
তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়ো না। দেখাই যাক না, কি হয়?
খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল তিনজনে। ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দিল কিশোর। রবিন আর মুসাকে এগিয়ে দিতে চলল লোহার বিশাল গেটের দিকে। ওদের গাড়িগুলো পার্ক করা রয়েছে ওখানে। লালচে হয়ে এসেছে আকাশ। তবে বেশিক্ষণ সে রঙ থাকল না।
অ্যাই, দেখো, হাত তুলল মুসা। রাস্তার ওপারে! বুকের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো রঙের পোরশে কনভারটিবল। কম করে হলেও ষাট হাজার ডলার দাম। দুর্দান্ত জিনিস।
গাড়ি দেখছে না কিশোর, তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। বনেটের ওপর ঝুঁকে রয়েছে যে। শান্ত কণ্ঠে বলল, দেখেছ। আর্মি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট। আমাদের মিস্টার এক্সও ওই পোশাকই পরেছিল…।