তার মানে কিশোরকেও ভাল লাগে, এটাই বোঝাতে চাইল মেয়েটা। ধরা যাক, তখন জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জুনের বন্ধু?
আসলে, আমি এসেছি খাবারে বিষ মেশানোর একটা ঘটনার তদন্ত করতে।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মেয়েটার। মানে! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে। তুমি গোয়েন্দা! কোন খাবারে বিষ মিশিয়েছে?
এখনও হয়তো মেশায়নি। হয়তো মেশানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্ভবত মুরগীতে।
আরও অবাক হয়ে গেল মেয়েটা। সর্বনাশ! কঠিন একটা প্রশ্ন করে বসল, কেন মেশাবে? লক্ষ লক্ষ লোককে কে, কি কারণে মারতে চাইছে?
জবাবটা এখনও জানি না। হতে পারে হেনরি অগাসটাস লারসেনকে ব্যবসা থেকে তাড়াতে চাইছে। ওরকম আরও হাজারটা কারণ থাকতে পারে। কোনটা যে ঠিক, এখনও বলতে পারছি না।
তোমার অনেক বুদ্ধি, কিশোরের কল্পনায় বলল মেয়েটা।
জানি। অনেকেই বলে সে কথা।
গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে তো অনেক বিপদে পড়তে হয়। পিস্তল চালাতে জানো? কারাতে, জুডো এসব…
কিছু কিছু আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারি। জুডো শিখছি। পুরোপুরি শেখা হয়নি এখনও।
কিন্তু হয়ে তো যাবে, থেমে গেল মেয়েটা। দাঁত দিয়ে নখ কাটল। তারপর আসল কথাটা জিজ্ঞেস করল, তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে?
এই রে! সেরেছে! আমতা আমতা করে বলল কিশোর, ইয়ে…মানে…
কিশোর! তোমার হলো?
চমকে বাস্তবে ফিরে এল কিশোর। ফিরে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রবিন। নেভি ব্লু কাপড়ে লাল স্ট্রাইপ দেয়া পোলো শার্ট গায়ে। পরনে ধবধবে সাদা প্যান্ট। সুন্দর লাগছে ওকে।
কার সঙ্গে কথা বলছিলে? গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল রবিন।
কারও সঙ্গে না, জবাব দিল কিশোর। কেসটা পর্যালোচনা করছিলাম, লাল হয়ে গেছে মুখ।
কোন চিন্তা মাথায় থাকলে একা একা কথা বলে কিশোর, ভাবনাগুলোই বিড়বিড় করে ভাবে, জানা আছে রবিনের। তাই আর এ নিয়ে মাথা ঘামাল না।
বেল এয়ারে চিকেন লারসেনের বিরাট বাড়ি। আগেই হাজির হয়ে গেছে মুসা আর ফারিহা। কিশোরদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
বাড়ি দেখেছ! দুই বন্ধুকে দেখেই বলে উঠল মুসা। গেট থেকে পুল পর্যন্ত যেতেই বাস লাগবে! আরিব্বাপরে বাপ!
তিনতলা বিশাল বাড়িটায় আটচল্লিশটা ঘর। আইভি লতায় ছাওয়া দেয়াল। কত কোটি কোটি ডলার কামিয়েছেন চিকেন কিং, বাড়িটা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। আরেকটা জিনিস স্পষ্ট, কি ব্যবসা করে টাকা কামিয়েছেন তিনি। সর্বত্র মুরগীর ছবি। যেখানে সুযোগ মিলেছে, মুরগীর ছবি আঁকা হয়েছে। যেখানে আঁকার জায়গা নেই, যেমন লনে, সেখানে রবারের মুরগী বানিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাড়ির পেছনে পুলের ধারে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। ছেলে-বুড়ো মিলিয়ে কম করে হলেও দুশো জন তো হবেই। পুলটার চেহারাও বিচিত্র। মুরগীর আকৃতিতে তৈরি। তার পাশে ফ্রাইড চিকেন খেতে খেতে হাসাহাসি করছে একদল ছেলেমেয়ে।
আমরা কিন্তু এখানে শুধু মজা করতে আসিনি, ফিসফিস করে বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। ফারিহা, গোয়েন্দা হওয়ার খুব শখ তো তোমার। ট্রেনিং নিতে শুরু করো। যা বলব ঠিক তাই করবে। জুনের কাছ থেকে কাপড়গুলো নেবে না, ভুলে যাওয়ার ভান করে থাকবে। তাতে আরেকবার ওর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবে।
আচ্ছা, ঘাড় কাত করে বাধ্য মেয়ের মত বলল ফারিহা। চলো, জুনের কাছে যাই। তোমরা যে এসেছ দেখা করা দরকার।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল চারজনে। সবার হাতেই কাগজের প্লেট। এমন ভঙ্গিতে খাচ্ছে, যেন জীবনে এই প্রথম মুরগীর স্বাদ পেয়েছে। এই আরেকটা জিনিস বিরক্ত লাগে ওর। মানুষগুলো এমন করে কেন? পোশাক-আশাকে তো কাউকেই দরিদ্র বলে মনে হচ্ছে না। তার পরেও অন্যের বাড়ির খাবার পেলে এমন হাংলামো করে! বিরক্তিতে নাক কুঁচকাল সে।
কিশোর, রবিন বলল। একটা অন্তত খাও। একটাতে তো আর মরে যাবে না।
রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ঠাট্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল। মাথা নাড়ল, না, খাব না।
তুমি আসলেই একটা গোঁয়ার…
হাই, খানিক দূর থেকে বলে উঠল একটা মেয়ে। কিশোরদেরই সমবয়সী। খাটো করে ছাঁটা বাদামী চুল। এক হাতে মুরগীর প্লেট, আরেক হাতে খালি একটা কাপ, সোডা ওয়াটার ছিল, খেয়ে ফেলেছে। আঁতকে উঠেছিল কিশোর, তাকেই ডাকছে ভেবে। যখন দেখল রবিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
তুমি আসার পর থেকেই তোমাকে দেখছি, রবিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল মেয়েটা।
রবিনও হাসল। তোমাকে তো চিনলাম না?
চোখ কপালে তুলল মেয়েটা। হায় হায়, বলো কি! আমাকে চেনো না? আরে আমি, আমি, ভাল করে দেখো তো চিনতে পারো নাকি?
ব্যস, শুরু হয়ে গেছে ন্যাকামি। বিরক্তিতে ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
কিন্তু রবিন দিব্যি হেসে চলেছে। মেয়েটার কথার জবাব তার মত করেই দিচ্ছে।
মরুকগে! একটা লাউঞ্জ চেয়ারে বসে পড়ল কিশোর। চিকেন লারসেনকে দেখতে লাগল। নাইট ক্লাবের কমেডিয়ানের মত আচরণ করছেন বিশালদেহী মানুষটা। একটু পর পরই গমগম করে উঠছে তাঁর ভারি কণ্ঠ। হা হা করে হাসছেন। পুলের পানির ওপর দিয়ে যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সে হাসি।
হঠাৎ আরেকটা কণ্ঠ কানে আসতেই ঝট করে সেদিকে ফিরল কিশোর। ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। সাদা স্যুট পরা একটা মানুষ, নিজের পরিচয় দিচ্ছে সোনালি চুলওয়ালা এক মহিলাকে। একটা বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি ফেলিক্স আরোলা।