কি আবার, পাজামা, হাসি হাসি গলায় বললেন লারসেন। নীল ব্লাউজটাও নিয়ে এসেছি। দেখ। এগুলো আনতেই তো বলেছিলি, নাকি?
যেটাতে বলেছিলাম সেটাতে খোঁজোনি, হেসে বলল জুন। অন্য ওয়ারড্রোব থেকে এনেছ। এই কাপড় পরে বাইরে বেরোনো যায়? তুমিই বলো?
চোখের সানগ্লাসটা ঠেলে কপালে তুলে দিলেন লারসেন। মেয়ের হাত থেকে নিলেন পাজামাটা। কেন, পরা যাবে না কেন? এ জিনিস পরে পার্টিতেও যেতে পারিস। স্বচ্ছন্দে। খারাপটা কি দেখলি?
মা বেঁচে থাকলে তোমার মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মারত এখন। এ জিনিস পরে বাইরেই বেরোয় না মেয়েরা। আর পার্টিতে যাওয়া!
কেন, অসুবিধেটা কি? শরীর ঢাকা থাকলেই হলো, বলতে বলতে ফারিহার দিকে চোখ পড়ল লারসেনের। তুড়ি বাজিয়ে বললেন, ব্যস, মিটে গেল ঝামেলা। ওর একটা কাপড় পরে নিলে পারিস। এই মেয়ে, একশো পনেরো হবে না তোমার ওজন?
থ হয়ে গেল ফারিহা। আপনি জানলেন কি করে?
জানব না মানে? তিরিশ গজ দূর থেকেও যে-কোন মুরগী দেখলে বলে দিতে পারি ওটার ওজন। আর তুমি তো মানুষ। তোমার পোশাক জুনের লাগবেই। একই গড়ন।
বাবা, অস্বস্তি বোধ করছে জুন। চুপ করো তো। ফারিহা, কিছু মনে কোরো না। বাবার ধারণা, দুনিয়ার সবাই এক। কেউ কিছু মনে করে না, আবার বাবার দিকে ফিরল। বাবা, এটা তোমার অফিসের ইন্টারকমের বোতাম নয়, যে টিপে যা বলবে তাই হয়ে যাবে।
আমি কিছু মনে করিনি, হেসে বলল ফারিহা। নাও না। লাগলে নাও আমার একটা কাপড়। অনেক আছে স্যুটকেসে। পরে ফেরত দিয়ে দিয়ো।
আচ্ছাহ! হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন জুন। তার বাবার আনা পোশাকগুলো পরে বেরোনোর কথা ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তার। স্যুটকেসের ডালা বন্ধ করল। কিছু মেকআপও ধার দিতে হবে। পারবে? আমার আব্বাজান আমার মেকআপ বক্সটা আনতেও ভুলে গেছেন, নেমে পড়ল বিছানা থেকে। বাবাকে এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো গালে। তোমার তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি, বাবা। তোমার অ্যামনেশিয়া হলো কি করে?
বোকার হাসি হাসলেন বাবা। আমারটা চিরকালের, জানিসই তো…তোর মা এ জন্যে কত বকাবকি করত…
জানি।
নিজের স্যুটকেসটা বয়ে জুনের এলাকায় নিয়ে এল ফারিহা। বিছানায় নামিয়ে রেখে বলল, নাও, যা ইচ্ছে বেছে নাও।
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বাড়ি গিয়েই ফেরত পাঠিয়ে দেব।
অত তাড়া নেই। যখন খুশি দিয়ো।
অ্যাই, শোন, জুন বলল। আমি জানি বাড়ি গিয়ে কি করবে বাবা। দুদিনের মধ্যেই একটা পার্টি দেবে। আমার হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার জন্যে উৎসব। এক কাজ করো না, তোমরাও চলে এসো। সবাইকেই দাওয়াত, তিন গোয়েন্দার কথাও বলল সে। পার্টিটা দারুণ হবে, আমি এখনই বলে দিতে পারি। তোমার কাপড়গুলো তখনই নিয়ে যেয়ো।
আচ্ছা।
খারাপ লাগল না তো? এসে নিয়ে যেতে বললাম বলে?
আরে না না, কি যে বলো। বরং খুশি হয়েছি। সত্যি।
হাসতে গিয়েও চেপে রাখল কিশোর। অতি আগ্রহটা প্রকাশ করল না। মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে যাওয়ার জন্যে। চিকেন কিং লারসেনের বাড়িতে দাওয়াত পাওয়ার সৌভাগ্য হবে, লোকটাকে আরও কাছে থেকে দেখতে পাবে, কল্পনাই করেনি কোনদিন। কিছুটা দেখেছে যদিও এই হাসপাতালে, আরও অনেক কিছু দেখা বাকি। জুনের পার্টিতে যাওয়ার চেয়ে ভাল সুযোগ আপাতত আর কিছু হতে পারে না।
৫
বিছানার কিনারে বসে পায়ে মোজা টেনে দিল কিশোর। লারসেনের বাড়িতে আজ পার্টির দাওয়াত। অস্বস্তি লাগছে তার। জটিল রহস্যের তদন্ত করতে হবে বলে ভয়টা, তা নয়, ভয় হলো এ ধরনের পার্টিতে অনেক ধরনের মানুষের সমাগম হয়। তাতেও খারাপ লাগত না। কিন্তু পার্টিটা একটা মেয়ের। তাতে ছেলেরা যেমন আসবে, তেমনি আসবে মেয়েরাও। ওদের সঙ্গে এমন সব কথা বলতে হবে ভদ্রতার খাতিরে, এমন আচরণ করতে হবে, যা সে করতে চায় না। মোটকথা ন্যাকামি এবং ভণিতা তার ভাল লাগে না।
উঠে গিয়ে ওয়ারড্রোব থেকে একটা উজ্জ্বল রঙের পোলো শার্ট বের করে গায়ে দিল। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের সুন্দর চেহারা এখন ওর জন্যে বিরক্তির কারণ। কোঁকড়া কালো চুল। গভীর কালো চোখে কেমন এক ধরনের মায়া, যেন স্বপ্ন ভরা। এই চোখের দিকে তাকিয়েই মেয়েরা… ধূর! আর ভাবতে চায় না!
আগে মোটামুটি সহজভাবেই মিশতে পারত মেয়েদের সঙ্গে। ইদানীং যতই বড় হচ্ছে, কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে ওর স্বভাব। ভাল অভিনেতা সে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় শুরু করল। ধরা যাক, একটা মেয়ে এসে আলাপ জমানোর চেষ্টা করল ওর সঙ্গে। বলল, এই যে, কিশোর পাশা। তোমার সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশি হলাম। তুমি খেয়াল করোনি। কিন্তু গত আধ ঘণ্টা ধরে তোমাকে লক্ষ্য করছি আমি।
কে বলল লক্ষ্য করিনি? আমি সব দেখি। আমার চোখে কিছুই এড়ায় না, জবাব দেবে কিশোর।
একটা চিকেন নেবে? সৌজন্য দেখিয়ে কাগজের প্লেটে করে চিকেন লারসেনের একটা বিশেষ খাবার বাড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
না, ধন্যবাদ, আয়নার দিকে তাকিয়ে কল্পিত মেয়েটাকে বলল কিশোর। আমি খাব না। আজেবাজে জিনিস খেতে মানা করে দিয়েছে ডাক্তার।
তাই নাকি? তোমার ওপর ভক্তি বেড়ে যাচ্ছে আমার, হাসি দিয়ে বলল মেয়েটা। এ রকম মনের জোরওয়ালা মানুষ আমার ভাল লাগে।