এত তাড়া কিসের তোমাদের? নার্স জিজ্ঞেস করল।
আছে। অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে জানতে চাই, ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল কিশোর।
কিছুই বলতে পারবে না ও। মনে করতে পারবে না। অ্যামনেশিয়ায় ভূগছে।
অ্যামনেশিয়া! ওই একটি শব্দই যেন হাজার টনী পাথরের মত আঘাত করল কিশোরকে। এত আশা, এত প্রতীক্ষা, সব যেন নিমেষে অর্থহীন হয়ে গেল।
অবশেষে জুনের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন লারসেন। বাইরে এলেন না, দরজায়ই দাঁড়ালেন। পরনে গাঢ় লাল জগিং স্যুট, হলুদ স্ট্রাইপ দেয়া। বুকের কাছে আঁকা কমলা রঙের মুরগী।
যাই, হ্যাঁ, মেয়েকেই বললেন বোঝা গেল। কাল আবার আসব। বাড়ি নিয়ে যাব তোকে। কিছু ভাবিসনে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
হেসে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন লারসেন। হাসিটা মুছে গেল পরক্ষণেই। আনমনে বিড়বিড় করে কি বললেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যেই বোধহয় হাসি হাসি করে রেখেছিলেন মুখ। তিন গোয়েন্দার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটিবারের জন্যেও ফিরে তাকালেন না।
কি বলছেন শুনতে পারলে হত, নিচু গলায় বলল মুসা।
কি যে করি জাতীয় কিছু বললেন বলে মনে হলো, আন্দাজ করল রবিন।
চলো, জুনের ঘরের দরজার দিকে রওনা হলো কিশোর।
বিছানায় উঠে বসেছে জুন। বয়েস উনিশ-বিশ হবে। পিঠে বালিশ ঠেস দেয়া। এলোমেলো চুল। অনেক সময় একটানা ঘুমানোয় ফুলে আছে মুখ। তবে বড় বড় নীল চোখজোড়া স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার।
এসেছ, মুসার দিকে তাকিয়ে যেন ওই একটি শব্দেই হুঁশিয়ার করে দিতে চাইল ফারিহা। রবিন আর কিশোরও বুঝল ওর ইঙ্গিত। জুনের দিকে ফিরল সে, জুন, এই হলো আমাদের তিন গোয়েন্দা। ও কিশোর পাশা, ও মুসা আমান, আর ও হলো রবিন মিলফোর্ড।
হাই, খসখসে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল জুন। তোমাদের কথা অনেক শুনেছি।
হেসে জিজ্ঞেস করল রবিন, এখন কেমন লাগছে?
আর কেমন। মনে হচ্ছে দালানের তলায় চাপা পড়েছিলাম। একটা হাড়ও আস্ত নেই। সারা গায়ে ব্যথা। বাবা যে কাল কি করে বাড়ি নিয়ে যাবে কে জানে।
ও কিছু না। ঠিকই যেতে পারবে। কাল সেরে যাবে, দেখ।
এসব কথা ভাল লাগছে না কিশোরের। আসল কথায় যেতে চায়। কিছুটা অধৈর্য ভঙ্গিতেই ফারিহার বিছানার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে এসে বসল জুনের বিছানার পাশে। তোমার অ্যাক্সিডেন্টটার কথা জানতে এসেছিলাম।
ফারিহা বলেছে, তোমরা আসবে। তবে আগেই একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার অ্যামনেশিয়া হয়েছে।
কিছুই মনে করতে পারছ না?
শেষ কথা মনে করতে পারছি, দুদিন আগে সকালে আমার বেড়ালটাকে, খাইয়ে বাবার অফিসে গিয়েছিলাম। আর কিছু মনে নেই। তবে ডাক্তার ভরসা দিয়েছে এই স্মৃতিবিভ্রম সাময়িক। শীঘ্রি আবার সব মনে করতে পারব। যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে স্মৃতি।
আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি, রবিন বলল। অনেক সময় কথা মনে করিয়ে দিলে মনে পড়ে যায় এসব অবস্থায়।
তাহলে অ্যাক্সিডেন্টের কথা কিছুই মনে করতে পারছ না? কিশোর তাকিয়ে রয়েছে জুনের মুখের দিকে। তোমার বাবার অফিসে কি জন্যে গিয়েছিলে?
কলেজ থেকে সবে ব্যবসার ওপর ডিগ্রী নিয়েছি, জুন জানাল। তাই বাবার ব্যবসাটায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এক ডিপার্টমেন্ট থেকে আরেক ডিপার্টমেন্টে ঘুরে বোঝার চেষ্টা করছি। যতই বই পড়ে শিখে আসি না কেন, হাতে কলমে কাজ করাটা অন্য জিনিস।
গত শুক্রবারে শেষ কোন ডিপার্টমেন্টে ঢুকেছিলে, কিশোর জিজ্ঞেস করল, মনে করতে পারো?
না।
ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখে কিছু কথা বলেছ। মনে করতে পারো?
মাথা নাড়ল জুন।
রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, চলো, বাইরে গিয়েই কথা বলি।
হলে বেরিয়ে এল তিনজনে। ভোতা গলায় কিশোর বলল, কোন লাভ হলো না।
ফারিহা আশা দিয়েছে, মুসা বলল। হবে।
হবে না। বসে বসে টেলিভিশন দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না ওর।
আমার তো এখন মনে হচ্ছে, কোন রহস্যই নেই, নিরাশ কণ্ঠে বলল কিশোর। ফারিহার কথাই আর বিশ্বাস করতে পারছি না।
ও এমনিতেও বাড়িয়ে কথা বলে, ফস করে বলে বসল রবিন।
রেগে গেল মুসা। ওর মাথায় আমার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি। কথা খুব ভাল মনে রাখতে পারে। কয়েক মাস আগেও কোন মেয়ে কোন পোশাকটা পরেছিল, কোন লিপস্টিক লাগিয়েছিল, ঠিক বলে দিতে পারে।
খুব ভাল, আরেক দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। যদি কোনদিন তিন গোয়েন্দা বাদ দিয়ে তিন ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে যাই, তাহলে ওকে আমাদের সহকারী করে নেব।
ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল মুসা।
রাগ কোরো না, ওকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। জুন একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। মাথায় গোলমাল হওয়াটা স্বাভাবিক। ঘুমের ঘোরে প্রলাপ বকাটা আরও বেশি স্বাভাবিক। এখন তো ধরেছে অ্যামনেশিয়ায়। ওর প্রলাপ বিশ্বাস করে রহস্য খুঁজতে যাওয়াটা কি ঠিক?
কেন, তোমার অনুভূতি কি এখন অন্য কথা বলছে…
অ্যাই, রাখ রাখ, হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেছে রবিন। একটা কথা…
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল কিশোর। কী?
একটা কথা খেয়াল করোনি? অ্যাক্সিডেন্টের দিনের কথা শুধু মনে করতে পারছে না জুন। কেন পারছে না? কেন একটা দিন স্মৃতি থেকে মুছে গেল?
তাই তো! ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগল কিশোর। তবে মনোযোগ দিতে পারল না। চেঁচিয়ে কথা বলছে নার্স মারগারেট, আমার কাজ আপনি করবেন? হাসালেন। এক ঘণ্টায়ই কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে আরম্ভ করবে। কানে রিসিভার ঠেকিয়ে মাথা কাত করে কাঁধ উঁচু করে রিসিভারটা ধরে রেখেছে সে। দুই হাত মুক্ত রেখেছে কাজ করার জন্যে। কিছু ফর্মে স্ট্যাম্প দিয়ে সীল মারছে। আপনি আমাকে বিরক্ত করে ফেলেছেন, বুঝলেন। আধ ঘণ্টা পর পরই জিজ্ঞেস করছেন জুন কেমন আছে। আরও তিরিশজন রোগী আছে এখন আমার হাতে। সবার আত্মীয়রাই যদি এভাবে ফোন করত, এতক্ষণে পাগলা গারদে পাঠাতে হত আমাকে। কেমন আছে জানতে চাইছেন তো? বলতে পারব না। হাসপাতালে এসে দেখে যান।