বড় একটা লাইব্রেরি। এক পাশের দেয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে বাধা কয়েকটা তৈলচিত্র। আরেক পাশে বিরাট এক আয়না। বাকি দুদিকের দেয়ালে অসংখ্য তাক, বইয়ে ঠাসা। র্যাক আছে অনেকগুলো।
লাইব্রেরিতে বই থাকবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু ওদেরকে অবাক করলো ঘড়ি। ছোট বড় নানারকম ঘড়ি রয়েছে ঘরটায়। মেঝেতে, টেবিলে, তাকে, দেয়ালে। নতুন-পুরনো, ছোট-বড়, দামী-কমদামী। তবে সব কটারই একটা বিশেষত্ব আছে, সবগুলোই বিদ্যুতে চলে। ফলে টিকটিক আওয়াজ না করে তুলেছে গুঞ্জন, যেন শত শত মৌমাছিকে কয়েদ করে রাখা হয়েছে ঘরটায়।
কি দেখছো? গোয়েন্দাদের তাজ্জব করে দিয়ে আনন্দ পাচ্ছে টিম। শুনলে আরও অবাক হবে, এর প্রত্যেকটা ঘড়িই চেঁচাতে পারে।
.
০৫.
চিৎকারে ভরে গেল যেন ঘরটা।
শুরু হলো শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে। তারপর গর্জাতে লাগলো একজন রেগে যাওয়া মানুষ। তৃতীয়টা বন্য, হিংস্র চিতাবাঘ। তারপর চারদিক থেকে শুরু হলো চিৎকার, কান্না, ফোপানি, গজানি, ফোঁসফোসানি-মানুষেরও, জানোয়ারেরও।
লম্বা একটা কাউচে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে তিন গোয়েন্দা। শিউরে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে।
একটা ডেস্কের ওপাশে বসে একের পর এক সুইচ টিপছে টিম। দাঁত বের করে হাসছে মেহমানদের দিকে চেয়ে। অবশেষে সব কটা সুইচ অফ করে দিলো। সে। নীরব হয়ে গেল ঘর।
জীবনে কখনও শুনেছো এরকম? বললো টিম।
ঘরটা কি সাউণ্ডপ্রফ? প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। এতোক্ষণে নিশ্চয় পুলিশকে ফোন করে দিয়েছে প্রতিবেশীরা।
অবশ্যই সাউণ্ডপ্রুফ। এটা মিস্টার রোজারের চেঁচানো ঘর। রাতে এখানে বসে। চেঁচানো শুনতেন…মানে… থেমে গেল টিম।
মিস্টার রোজারের কিছু হয়েছে?
কেন? হবে কেন?
ওই যে, শুনতেন বললে। তারপর থেমে গেলে। ভাবলাম, কিছু হয়েছে।
চলে গেছে, ব্যস। তাতে তোমাদের কি?
আমাদের? না, কিছু না। চেঁচানো ঘড়ি দিয়ে শুরু করেছিলাম। ঢুকলাম। চেঁচানো ঘরে। এখন শুনছি এর মালিকই গায়েব। রহস্য জটিল হচ্ছে আরকি। আচ্ছা, বলতে পারো, কেন এতোগুলো ঘড়িতে চিৎকার ঢোকালেন তিনি? কিছু তো বুঝতে পারছি না।
এতে আর বোঝাবুঝির কি আছে? বলে উঠলো মুসা। মাথায় ছিট ছিলো আরকি। নইলে রাতে একলা বসে চেঁচামেচি শোনে কেউ?
এটা তাঁর হবি ছিলো, মিস্টার রোজারের পক্ষ নিলো টিম। অনেক হবিরই কোনো অর্থ থাকে না। তোমাদেরটার আছে?
আছে, মাথা কাত করলো কিশোর। রহস্যের সমাধান করা। এই যেমন, ঘড়ি-রহস্যের সমাধান করতে এসেছি।
আমি তো বলছি, এতে কোনো রহস্য নেই!
তাহলে ওরকম আচরণ করছো কেন? এমন ভাব করছে, যেন দুনিয়ার সবাইকে ঘৃণা করো। খুলে বলছো না কেন? সব শুনলে হয়তো সাহায্য করতে পারবো।
তোমরা কি সাহায্য করবে? জ্বলে উঠলো টিম। আর আমিও অদ্ভুত আচরণ করছি না। তোমরাই বরং করছে। এখন যাও, ওঠো। একা থাকতে দাও আমাকে প্রায় ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। পথ দেখো! আর কখনও আসবে না…আরি!
দরজায় দেখা দিলো একজন লোক। তেমন লম্বা নয়, কিন্তু কাধ খুব চওড়া। তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে ভুরু কোঁচকালো। কারা ওরা, টিম? বন্ধু নিয়ে এসেছো খেলতে, গোলমাল করতে, আমাকে বিরক্ত করতে? বলে দিয়েছি না, হৈ চৈ আমি একদম পছন্দ করি না?
হৈ-চৈ করছি না আমরা, মিস্টার লারমার, গম্ভীর হয়ে বললো টিম। আর শব্দ তো বাইরে যায় না। এই ঘর সাউণ্ডপ্রুফ। আপনার অসুবিধে-..
হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলো লারমার। দীর্ঘ এক মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে রইলো তিন গোয়েন্দার দিকে, যেন তাদের চেহারা মনে গেঁথে নিলো। বললো, যাচ্ছি। তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
দুপদাপ করে পায়ের শব্দ হলো দোতলার সিঁড়িতে।
কাউকে তোমাদের বাড়িতে আনলে তার কি? লারমারের ব্যবহারে কিছুটা অবাকই হয়েছে রবিন। বাড়িটা তোমাদের, তাই না?
না, মিস্টার রোজারের। আমার মা তার হাউসকীপার। তিনি চলে যাওয়ার পর ওপর তলার ঘরগুলো লারমারকে ভাড়া দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে মা। যাও, এখন যাও তোমরা। ঝামেলাতেই ফেলেছো…
যাচ্ছি। সহকারীদের দিকে ফিরে বললো কিশোর, চলো যাই। টিমকে বললো, অনেক ধন্যবাদ, টিম, ঘড়িগুলো দেখানোর জন্যে।
হলে ফিরে টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরলো কিশোর। বেরিয়ে চলে এলো রোলস রয়েসটা যেখানে পার্ক করা আছে।
দূর, কোনো লাভ হলো না, গাড়িতে উঠে বললো মুসা। ঘড়ি জোগাড়ের নেশা আছে লোকটার। ব্যস, রহস্য ওই পর্যন্তই।
হুঁ, বলে কি বোঝাতে চাইলো কিশোর, বোঝা গেল না। হ্যানসনকে বললো, হলিউডে এলামই যখন, মিস্টার ক্রিস্টোফারের অফিসে একবার ঢু মেরে যাই। কি বলেন?
নিশ্চয়ই, বলে এঞ্জিন স্টার্ট দিলো হ্যানসন।
দাঁড়ান, দাঁড়ান! বলে উঠলো রবিন।
সবাই দেখলো, টিম দৌড়ে আসছে। পাশের জানালা নামিয়ে দিলো মুসা। কাছে এসে হাঁপাতে লাগলো ছেলেটা। যাক, ধরতে পেরেছি…দেখো, সত্যি আমার সাহায্য দরকার। থেমে দম নিলো সে। আমার বাবা জেলে, কোনো অপরাধ না করেই। তাকে যদি নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারতে, বড় উপকার হবে।
০৬.
গাড়িতে ওঠো, দরজা খুলে দিয়ে ডাকলো কিশোর। খুলে বলো সব বুঝে দেখি সাহায্য করতে পারবো কিনা।
পেছনের সিটে চাপাচাপি করে বসলো চার কিশোর। অল্প কথায় সব জানালো টিম। বছর তিনেক আগে স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে, এসে থাকার জন্যে মিস্টার রোজারের বাড়িতে উঠেছিলো তার বাবা বেকার ডেলটন। বীমা কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ করতো। সামান্য আয়ে সংসার চলতো না। তাই বাধ্য হয়ে মিস্টার রোজারের হাউসকীপারের চাকরি নিয়েছিলো টিমের মা। বাড়ির পেছনে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসও বিনা ভাড়ায় পেয়েছিল থাকার জন্যে।