আপনার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টাই করছি আমরা, মিসেস ডেলটন, শোঁপা বললো। প্রমাণ খুঁজছি। নির্দোষ যে, এটা প্রমাণ করতে হবে আদালতে। আর খুঁজতে মানা করছেন?
নষ্ট যা করার তো করেই ফেলেছেন। আর বাকিই বা আছে কি। খুঁজুন। দেখুন, প্রমাণ বেরোয় কিনা।
না, আর-কিছু ভাঙবো না। হলে এখন ভালোভাবেই হবে। তবে এই-ই শেষ চেষ্টা।
আপাতত আর কিছু করার নেই। টেপ আর রেকর্ডার এলে তারপর যা করার করবে। কাজেই বসে থাকতে হলো। গাড়ি নিয়ে মিক গেছে ওগুলো আনার জন্যে।
ঘন্টাখানেক পর ফিরলো সে। ভারি মেশিনটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো, আরিব্বাপরে, দশ মন হবে! টেপ ঢুকিয়েই দিয়েছে এর মধ্যে। শুধু চালালেই হবে এখন।
কিশোর, শোঁপা বললো, চালাতে পারবে এটা?
পারবো। উঠে এসে চামড়ার বাক্স থেকে মেশিনটা বের করলো কিশোর। সকেটে প্লগ ঢুকিয়ে কানেকশন দিলো। ভুল হয়ে গেছে। এতোক্ষণ শুধু শুধু বসে না থেকে ঘরটা গুছিয়ে ফেলতে পারতাম। ঠিক আগের মতো হবে না, যতোটা পারা যায় আরকি। ছবিগুলো জায়গা মতো ঝোলাতে হবে, আয়নাটা আগের জায়গায়। বইগুলো তাকে।
প্রতিবাদ করতে গিয়েও কি ভেবে থেমে গেল শোঁপা। সঙ্গীদের নির্দেশ দিলো কাজ করার।
আয়নাটা লাগালো ওরা। ছবিগুলো ঝোলালো। বই যতোগুলো সম্ভব, তুলে সাজিয়ে রাখলো তাকে, আর বুকশেলফে।
উহ্, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। নাও, শুরু করো, কিশোরকে বললো শোঁপা। দেখো, কিছু হয় কিনা।
টেপ চালু করে দিলো কিশোর। ভলিউম কমিয়ে রেখেছে। বসে থাকেনি সে। টেপটা চালিয়ে সেই জায়গায় নিয়ে এসেছে, যেখান থেকে শুরু হয়েছে চিৎকার। ওয়াইও করে সামান্য পিছিয়ে নিয়ে আবার প্লে-এর বোতামটা টিপে দিলো। বললো, সবাই চুপ, প্লীজ। একটুও শব্দ করবেন না।
সবাই নীরব হতেই ভলিউম বাড়িয়ে দিলো কিশোর।
নারী-পুরুষের কিছু সংলাপের পর চিৎকারটা হলো। তীক্ষ্ণ, কাঁপা কাঁপা, ভয়ঙ্কর। বদ্ধঘরে প্রতিধ্বনি তুললো। শেষ হলো ধীর লয়ে।
সবাই অধীর হয়ে আছে। ভাবছে, দেয়ালের কোথাও কোনো গোপন ফোকরের দরজা খুলে যাবে, কিংবা দেয়ালের কোনো জায়গায় ফাঁক দেখা দেবে। আরব্য উপন্যাসের আলিবাবার গুহার মতো।
সে-রকম কিছু ঘটলো না।
জানতাম, হবে না! উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, ধপ করে আবার বসে পড়লো শোঁপা। ঘাড় ডলছে। ওরকম কিছু থাকলে আগেই পেয়ে যেতাম। তেমন। জায়গা নেই এঘরে। ছবিগুলোও নেই।
আমার মনে হয়, আছে, হঠাৎ-আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লো কিশোর। একটা পরিবর্তন চোখে পড়েছে তার। বুঝতে পারছে, কোথায় লুকানো রয়েছে ছবিগুলো। আবার করে দেখি, বললো সে। ভলিউম বোধহয় আরও বাড়াতে হবে।
ভলিউম পুরো বাড়িয়ে দিলো কিশোর। টেপ রিওয়াইণ্ড করে প্লে-বাটন টিপলো।
ভীষণ চিৎকার যেন চিরে দিলো কানের পর্দা। চড়ছে…চড়ছে…চড়ছে..কানে আঙুল দিতে হলো সবাইকে।
এই সময় ঘটলো ঘটনাটা।
ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল বড় আয়নাটা। ঝুরঝুর করে মেঝেতে ঝরে পড়লো কাঁচ। মাত্র এক সেকেণ্ডেই ফ্রেমে আটকানো কয়েকটা ছোট টুকরো ছাড়া আর সব পড়ে গেল।
আয়নার জায়গায় এখন দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল রঙের একটা ছবি। ওদের চোখের সামনেই গোল হয়ে মুড়ে মেঝেতে পড়ে গেল ওটা। পেছনে আরেকটা। ওটাও পড়লো। তার পেছনে আরও একটা। পর পর পাঁচটা ছবি পড়লো কাঁচের টুকরোর ওপর। ফ্রেমের পেছনের শক্ত পর্দা আর আয়নার মাঝখানে রাখা হয়েছিলো। ছবিগুলো।
অবশেষে বোঝা গেল চেঁচানো ঘড়িতে অ্যালার্মের জায়গায় চিৎকারের ডিস্ক লাগানোর কারণ।
ছুটে গেল শোঁপা। কাঁচের পরোয়া করলো না, মাড়িয়ে গিয়ে নিচু হয়ে তুলে নিলো একটা ছবি। কালোর পটভূমিকায় ঝলমল করে উঠলো গাঢ় লাল, নীল, সবুজ। এগুলোই! হ্যাঁ, এগুলোই! ফিসফিস করছে সে, যেন জোরে কথা বললে কাঁচের মতোই ছবিগুলোও চুরমার হয়ে যাবে। দশ লাখ ডলার..পেলাম…
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল লাইব্রেরির ভেজানো দরজা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ এলো, খবরদার, নড়বে না! হাত তোলো!
এক মুহূর্ত স্তব্ধ নীরবতা।
দরজার দিকে ঘুরে গেল সাত জোড়া চোখ।
দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে দুজন পুলিশ। হাতে উদ্যত, রিভলভার। তাদের পেছনে উঁকি দিচ্ছে পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের মুখ। তার পেছনে মুসার বাবা মিস্টার রাফাত আমান। দুজন পুলিশের মাঝের ফাঁক বেড়ে গেল, ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের। সেখানে দেখা দিলো আরেকটা মুখ। মাথার খুলি কামড়ে রয়েছে যেন বাঁকা তারের মতো চুল, খাটো করে ছটা। কুচকুচে কালো মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত, ছবিগুলোর মতোই ঝলমল করছে ঝকঝকে সাদা দাঁত।
খাইছে, কিশোর, বলে উঠলো মুসা আমান। এক্কেরারে সময়মতো হাজির হয়ে গেছি, না? তা ঠিকঠাক আছো তো তোমরা? ঘুমোতে গিয়েছিলাম, বুঝলে। ঘুম এলো না। কেন যেন খালি দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো তোমাদের জন্যে। তাছাড়া বাবা। একটা কথা বলেছে, খচখচ করছিলো মনে। তোমাকে বলার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম। সকালের জন্যে আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে ফোন করলাম। তোমাদের বাড়িতে। শুনলাম রবিনদের বাড়ি গেছে। করলাম ওদের ওখানে। রবিনের মা বললো, রবিন তোমাদের ওখানে গেছে। ভাবলাম, হেডকোয়ার্টারে আছো। ফোন করলাম। ধরলো না, কেউ। সন্দেহ হলো। ছুটে গেলাম ওখানে। টেবিলের ওপর পেলাম তোমার নোট। ফোন করলাম এখানে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেছি। কেউ ধরলো না। তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে বাবাকে বললাম। তাকে নিয়ে। সোজা ছুটলাম থানায়। তারপর আর কি। পুলিশ নিয়ে চলে এলাম।