ওই আশা মনে নিয়েই নীরব হলো দুজনে। ভ্যান চলেছে। মোড় নিচ্ছে মাঝে মাঝে। বুঝতে পারলো না ওরা যাচ্ছে কোনদিকে। দীর্ঘ কয়েক যুগ পরে যেন অরশেষে থামলো গাড়ি। বড় একটা দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। ঝনঝন করে উঠে গেল স্পিঙ লাগানো দরজা, বোধহয় কোনো গ্যারেজের। আবার চললো ভ্যান, কয়েক ফুট এগিয়ে থামলো। পেছনে দরজা নামিয়ে দেয়ার শব্দ। ভ্যানের দরজার তালা খুললো খাটো লোকটা, ডিংগো।
নামো, দুজনেই, আদেশ দিলো সে। ভালো চাইলে চুপচাপ থাকবে। নইলে কপালে দুঃখ আছে।
রবিন আগে নামলো, পেছনে টিম। কংক্রীটের মেঝে। চারপাশে চোখ বোলালো রবিন। গ্যারেজই, বড় একটা ডাবল-গ্যারেজ। দরজা নামানো। দুপাশে দুটো জানালা, পর্দা টানা, পাল্লা বন্ধ কিনা বোঝা গেল না। মাথার ওপরে একটা বাল্ব জ্বলছে। আর কোনো গাড়ি নেই। একটা গাড়িই বোধহয় রাখা হয়, কারণ আরেকটা গাড়ির জায়গাকে ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করে–জিনিসপত্র দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একটা ওয়ার্কবেঞ্চ, একটা ব্রোল্যাম্প আর কিছু যন্ত্রপাতি আছে।
বেঞ্চের পাশে কয়েকটা চেয়ার। সেগুলো দেখিয়ে ডিংগো বললো, যাও, বসো। মুখে কুৎসিত হাসি। আরামেই বসো, কষ্ট করার দরকার নেই।
রবিন আর টিম বসলো।
নগ্ন আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে লারমারের লম্বা মুখটা, চোখ আর নাকের নিচে অদ্ভুত ছায়া কেমন যেন কিস্তুত করে তুলেছে চেহারাটাকে। এগিয়ে এলো দুই, কদম। তার পেছনে ভ্যান থেকে নেমে হাসিমুখে এগোলো লম্বা লোকটা, মারকো।
দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধো, ডিংগোকে আদেশ দিলো লারমার। তারপর কথা।
বেঞ্চের ওপর থেকে দড়ি এনে রবিন আর টিমকে চেয়ারের সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধলো ডিংগো।
একটা চেয়ার টেনে ওদের মুখোমুখি বসলো লারমার। সাগর কলার মতো মোটা এক সিগার ধরিয়ে আরাম করে টান দিলো কয়েকটা। মুখ-ভর্তি ধোয়া নিয়ে। ফুঁ দিয়ে ছাড়লো দুই বন্দির মুখে। ফিকফিফ করে হাসলো শয়তানী হাসি। তামাক পছন্দ না, না? তোমার বয়েসে আমি অবশ্য খুবই পছন্দ করতাম। কি স্বাদ যে মিস করছো, বুঝতে পারছে না।
স্বাদের দরকার নেই আমার, গম্ভীর হয়ে বললো রবিন। ফুসফুস কালি করার। কোনো ইচ্ছে নেই।
ভালো কথা। বোঝা গেল, নিজের জন্যে মায়াদর আছে। প্রশ্নের জবাব তাহলে সরাসরিই দেবে আশা করি। সিগারে আরেকটা লম্বা টান দিলো সে। হ্যাঁ, টিম নিশ্চয় সব জানিয়েছে?
বলেছে, মেসেজের মানে আপনারা জানতে চান, গলা কাঁপছে রবিনের।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে। দামী কিছু জিনিস কোথাও লুকানো আছে। মেসেজে আছে ইঙ্গিত। জানতে চাই, সেটা কোথায়। ভুরু কুঁচকে বিকট করে তুললো চেহারাটা। বদলে গেল কণ্ঠস্বর, মেসেজগুলো কিভাবে পেয়েছো, জানি। চেঁচানো ঘড়িটা পেয়ে, হ্যারিসন ক্লকের কথা জেনে গেছো তোমরা। ঠিক গিয়ে খুঁজে বের করেছো হেনরি মিলারকে, তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এসেছে। আরও দুজনের কাছ থেকে দুটো মেসেজ এনেছো। রবিনের চোখে চোখে তাকালো। এখন বলে ফেলো, কি লেখা আছে ওগুলোতে।
আর হ্যাঁ, রবিন জবাব দেয়ার আগেই মারকো বললো, আমি জানতে চাই, হেনরি মিলারের কাছে ওই চেঁচানো ঘড়িটা পাঠানোরই বা কি অর্থ? ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে কেন পাঠিয়েছে মেসেজগুলো? কি খেলায় মেতেছে হ্যারিসন ক্লক?
ক্লক কি খেলায় মেতেছে, সেটা ও জানবে কি করে? ডিংগো বললো। ক্লকের পেটে খালি শয়তানী বুদ্ধি, কথা পর্যন্ত সোজা করে বলে না। কেন করেছে এসব, একমাত্র ও-ই বলতে পারবে। আর যেহেতু ওকে পাওয়া যাচ্ছে না…
জানাও যাবে না, বাক্যটা শেষ করে দিলো লারমার। ওসব জানার দরকারও নেই আমাদের। মাল কোথায় লুকানো আছে, এটা জানলেই আমি খুশি। নাও খোকা, শুরু করো। মেসেজে কি বলেছে?
জোরে ঢোক গিললো রবিন। ইয়ে, একটা মেসেজের মানে বের করেছি আমরা। লিখেছেঃ আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক। ব্যস। এই একটা লাইনই।
আই সাজেস্ট ইউ সী দা বুক! ঠোঁট কামড়ালো লারমার। কি বই?
জানি না, বলেনি।
দ্বিতীয়টায় নিশ্চয় বলেছে, অধৈর্য হয়ে উঠছে লারমার। কি লিখেছে?
জানি না, আবার ঢোক গিললো রবিন। মানে করার সময়ই পাইনি। ক্লান্ত ছিলাম। আগামী কাল করবো ভেবেছি।
দেখো, ছেলে! কঠোর কণ্ঠে বললো লারমার, মিথ্যে বলো না! দ্বিতীয় মেসেজে কি লিখেছে জলদি বলো!
সত্যি বলছি আমি জানি না। ওটা নিয়ে ভাবিইনি। কাল সকালের জন্যে রেখে দিয়েছি।
সত্যি কথাই বলছে মনে হয়, মারকো বললো।
হয়তো, নিশ্চিত হতে পারছে না লারমার। বেশ, ধরে নিলাম, দ্বিতীয়টার মানে জানো না। তৃতীয়টার? ওটা তো জানো? ওই যে, শুধু নম্বর লেখা আছে যেটায়। অর্ধেকটা আমার কাছে, মারকো ছিঁড়ে রেখে দিয়েছিলো। পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজটা বের করে রবিনের নাকের কাছে নাড়লো। কি মানে এসব নম্বরের?
আমি বলতে পারবো না, মাথা নাড়লো রবিন। কিশোর হয়তো পারবে।
ভীষণ হয়ে উঠলো লারমারের কুৎসিত চেহারা। তবে, নিশ্চিত হলো, রবিন। মিথ্যে বলছে না।
তার মানে আরও অপেক্ষা করতে হবে আমাদের, মারকো বললো। সেটা করতে তো আপত্তি ছিলো না, কিন্তু অসুবিধে আছে। ছেলেগুলো বুঝে ফেললেই পুলিশের কাছে যাবে, তাদের নিয়ে যাবে লুকানোর জায়গাটায়। আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না তখন। কাজেই দেরি করা যাচ্ছে না। তো, কী করা?