বাইরে আওয়াজ শুনে গিয়ে সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো কিশোর। পেরিস্কোপটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা বিশেষ অবস্থানে আনতেই ইয়ার্ডের অনেকখানি দেখা গেল।
ওই, এসে গেছে।
একটু পরেই ট্র্যাপডোরে টোকা পড়লো। ঢাকনা তুলে উঠে এলো রবিন। হাতে নোটবুক, ভীষণ উত্তেজিত।
রবিনের মুখ দেখেই আন্দাজ করা গেল, খবর আছে।
সারাটা সকাল খরচ হয়েছে আমার, রবিন, বললো। কারনিভলে গুরুত্ব নেই, ফলে খবর থাকলেও কাগজের চিপায়-চাপায় থাকে। একগাদা কাগজ ওল্টাতে হয়েছে আমার।
কি জানলে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
নোটবুক খুললো রবিন। তিন হপ্তা আগে ভেনচুরায় পনি রাইড হারিয়েছে কারনিভল। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে ওদের তিনটে খেলুড়ে পনি ঘোড়া। তারপর, তিন দিন আগে স্যান মেটিওর উত্তরে একটা জায়গায় থাকার সময় আগুন লেগেছে। তিনটে তাঁবু পুড়েছে আগুনখেকোর তাঁবু, সিংহের তাঁবু, আর শুটিং গ্যালারির খানিকটা নেহাত কপালগুণে সময়মতো নেভাতে পেরেছে।
সিংহের তাঁবু? কপাল কুচকে গেছে মুসার। একখানে দুবার অঘটন?
কাকতালীয় ব্যাপারও হতে পারে, কিশোর বললো। ঝট করে সিদ্ধান্তে চলে আসা ঠিক নয়। তবে ইন্টারেসটিং মনে হচ্ছে। যদি পনি রাইডও ওই একই কারনিভলের হয়।
কোন কারনিভল, পেপারে কিছু লেখেনি, রবিন বললো।
কাল রাতে আমি ও কিছু বইপত্র ঘেঁটেছি, সার্কাসের ওপর লেখা, বললো। কিশোর। চাচার বই। জানোই তো সার্কাসে কি-রকম আগ্রহ তার। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে একবার সার্কাসের দলে ভর্তিও হয়েছিলো। একটা বইতে পেলাম, অনেক কুসংস্কার আছে সার্কাসের লোকের। পুরনো প্রবাদ আছেঃ কোনো সার্কাসে দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করলে পর পর তিনবার ঘটবে। ঘটবেই। সুতরাং, কিঙের বেরিয়ে যাওয়াটা তৃতীয় দুর্ঘটনা বলা যায়।
তুমি বিশ্বাস করো এসব? রীতিমতো অবাক হলো মুসা।
আমার করা না করায় কিছু এসে যায় না, সেকেণ্ড। সার্কাসের লোকে করে। আরও কিছু বইয়ের লিস্ট দিয়েছে চাচা, তার কাছে ওগুলো নেই। ফলে সকালে লস অ্যাঞ্জেলেসে যেতে হলো, লাইব্রেরিতে। অনেক বই ঘেটেছি। জেনেছি, সার্কাসে কি। কি খেলা থাকে, কোন পদে কি রকম লোক থাকে। আশ্চর্য কি জানো, কোথাও স্ট্রং ম্যানের উল্লেখ নেই।
তাহলে কোহেন? প্রশ্ন তুললো মুসা।
কি জানি। হতে পারে নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে। কিংবা তার দেশের সার্কাসে। ওরকম, পদ আছে। লোকটা বিদেশী। আরেকটা ব্যাপার সহজেই চোখে পড়ে, তার। আচার-আচরণ সন্দেহজনক। ঝিক করে উঠলো কিশোরের চোখের তারা। তুড়ি বাজালো। পেয়েছি।
কি পেয়েছো?? একসঙ্গে প্রশ্ন করলো দুই সহকারী।
কারনিভলে তদন্ত করার উপায়। জড়িয়ে নিতে হবে।
কিভাবে? রবিন জানতে চাইলো
বলছি, মন দিয়ে শোনো…
.
কয়েক মিনিট পর সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো মুসা। হঠাৎ বললো, আসছে! আমি যাই।
তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপের বাইরে রবির সঙ্গে দেখা করলো মুসা। ফোন করে তাকে আসতে বলেছে কিশোর।
কি ব্যাপার, মুসা? হাসলো সোনালি-চুল ছেলেটা। জরুরী তলব?
ভাবলাম, আমাদের গোপন হেডকোয়ার্টার দেখাই। হাজার হোক, তিনটে ফ্রি পাস পেয়েছি তোমাদের কাছে। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে। কি করে কাজ করি আমরা, দেখবে এসো।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে রবিকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে এলো মুসা।
কি সাংঘাতিক! কি জায়গা বানিয়ে রেখেছো জঞ্জালের তলায়!
চোখ বড় বড় করে দেখলো রবিঃ মাইক্রোস্কোপ, টেলিফোন, পেরিস্কোপ, ওয়াকি-টকি, ফাঁইলিং কেবিনেট, মেটাল ডিটেকটর, তাক বোঝাই বই আর ট্রফি, আর আরও নানা রকম জিনিস যেগুলোর নামই জানে না সে। রবিন আর কিশোর কাজে ব্যস্ত, ঘরে যে লোক ঢুকেছে টেরই পায়নি যেন। একজনও চোখ তুললো না। আতশ কাঁচ দিয়ে একটা তালা পরীক্ষা করছে কিশোর। আলোকিত কাঁচের তলায় রেখে কি যেন দেখছে রবিন।
ওদের কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নিচু গলায় বললো মুসা, রবি, তোমাদের কারনিভলে গোলমাল হচ্ছে। সেটারই তদন্ত করছি।
কি করে জানলে? অসম্ভব!
তোমার কাছে কঠিন লাগছে, রবি, ভারিক্কি চালে বললো মুসা। আমাদের কাছে কিছু না। বিজ্ঞান আর আমাদের অভিজ্ঞতাই সেটা সম্ভব করেছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো কিশোর। বুঝলাম। কিংকে ছেড়ে দেয়েছিলো একজন। পেশাদার অপরাধী, রবি যে আছে ঘরে দেখতেই পায়নি যেন। কোনো সন্দেহ নেই। তালাটার বাইরের প্যাটার্ন দেখলাম, টাইপ-সেভেন পিক-লক। সিংহের খাঁচায়ও একই তালা। নিশ্চয় গোলমাল পাকানোর জন্যেই খুলে দেয়া হয়েছিলো।
বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে রবি, অর্ধেক কথা বুঝতে পারছে না। আরও তাজ্জব হওয়া বাকি আছে তার। কিশোর থামতেই রবিন শুরু করলো, হুঁ, বোঝাই যাচ্ছে, তিন হপ্তা আগে তিনটে ঘোড়া মরে যাওয়াতেই পনি রাইড খেলাটা বন্ধ। করতে হয়েছে। তারপর পুড়লো তবু, শুটিং গ্যালারির ক্ষতি হলো। নতুন তবু কিনতে, গ্যালারি মেরামত করতে অবশ্যই টাকা নষ্ট হয়েছে। বেকায়দায় পড়ে গেছেন মিস্টার কনর। বেতন দিতে পারছেন না।
রবিকে না দেখার অভিনয় চালিয়ে গেল কিশোর। মাথা ঝাঁকিয়ে রবিনের কথার সমর্থন জানালো। জিজ্ঞেস করলো, কর্মীদের কথা কি কি জানলে?
স্ট্রং ম্যান কোহেন কারনিভলে আগে কখনও কাজ করেনি, রেকর্ড নেই। আমার বিশ্বাস, লোকটা ভণ্ড।
ভাব দেখে মনে হলো, বাজ পড়েছে রবির মাথায়। ঝুলে গেছে নিচের : চোয়াল। আর চুপ থাকতে পারলো না। এসব কথা কে বলেছে তোমাদের?