আরও অস্বস্তিতে পড়লো মুসা, কোনোমতে হাসলো। আমি জানতাম, স্যার, ও পোষা। নইলে কখন, ভাগতাম।
তবু আমি বলবো দুঃসাহস দেখিয়েছো। খাঁচার ভেতর সিংহ দেখেই কতোজনে ভয় পেয়ে যায়। তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে চোখ নাচালো লায়ন। ট্রেনার। কিঙের খেলা দেখবে?
দেখাবেন? উৎসাহে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। কখন?
কয়েক মিনিটের মধ্যেই খেলা শুরু হবে।
নিজের তাঁবুতে ফিরে চললো মারকাস। এখানে আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে, রবি ফিরে গেল তার নিজের বুদে। শুটিং গ্যালারিতে তখন রীতিমতো ভিড় জমেছে।
সিংহের খেলা যে তাঁবুতে দেখানো হবে সেদিকে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। পথে দেখা গেল, দর্শক জমিয়ে ফেলেছে দুই ভাড়। একজন বেঁটে, মোটা। আরেকজন লম্বা, পাতলা নাক, বিষণ্ণ চেহারা, সাদা রঙ মেখে আরও বিষণ্ণ করে ফেলেছে। ভবঘুরে সেজেছে সে। ঢোলা প্যান্টের পায়ের কাছটা বেঁধেছে দড়ি দিয়ে। তার সঙ্গী হাসিখুশি। নানারকম শারীরিক কসরত দেখাচ্ছে, ডিমে তা-দেয়া। মুরগীর মতো বিচিত্র শব্দ করছে গলা দিয়ে।
বিষণ্ণ চোখে সঙ্গীর খেলা দেখছে লম্বা ভড়, তাকে অনুসরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। করুণ করে ফেলছে চেহারা। আবার চেষ্টা করছে, আবার বিফল হচ্ছে। বিষণা থেকে বিষণ্ণতর হয়ে যাচ্ছে চেহারা। তার এই কাণ্ড দেখে দর্শকরা হেসে অস্থির। শেষে, কঠিন একটা খেলা দেখাতে গিয়ে ইচ্ছে করেই ব্যর্থ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়লো বেঁটে ভাড়। অবশেষে হাসি ফুটলো লম্বার মুখে।
চমৎকার অভিনয়, কিশোর বললো। সে নিজে ভালো অভিনেতা, তিন বছর বয়েসেই অভিনয় করেছে টেলিভিশনে। ফলে কারও ভালো অভিনয় দেখলে ভালো লাগে তার।
সিংহের তাঁবুর দিকে চললো আবার ওরা। তাঁবুর এধারে পর্দা দিয়ে আলাদা। করা। এপাশে দর্শকদের দাঁড়ানোর জায়গা। বড় একটা খাঁচা, মাঝে শিকের আলগা বেড়া দিয়ে আলাদা করা। ভেতরে সেই গামলা: দুটো, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে রঙ করে আনা হয়েছে যেগুলো। খাঁচার ছাত থেকে ঝুলছে একটা ট্রাপিজ।
ছেলেরা তাঁবুতে ঢোকার পর পরই পর্দার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো। মারকাস। দর্শকদের উদ্দেশ্যে বাউ করে গিয়ে খাঁচায় ঢুকলো। মাঝের বেড়াটা সরিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে ডাকলো। ভয়ঙ্কর বুনো গর্জন করতে করতে খাঁচার এধারে চলে এলো কিং। চক্কর দিতে লাগলো খাঁচার স্বল্প পরিসরে, চোখমুখ পাকিয়ে এসে থাবা মেরে মারকাসকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো।
হাসলো ছেলেরা। বুঝতে পারছে, সিংহটাও অভিনয় করছে ট্রেনারের সঙ্গে। লাফালো, গড়াগড়ি দিলো, নাচের ভঙ্গিতে পা ফেললো, ডিগবাজি খেলো, সব শেষে লাফিয়ে উঠলো ঝুলন্ত ট্র্যাপিজে। চোখ কপালে তুলে দিলো দর্শকদের।
আরিব্বাপরে! মুসা বললো। কতো কি করছে! আমি তো শুধু ওকে শুইয়েছি।
খুব ভালো খেলা দেখাচ্ছে, তাই না, কিশোর? বলে, পাশে দাঁড়ানো কিশোরকে কনুই দিয়ে গুঁতো মারতে গেল রবিন, কাত হয়ে গেল একপাশে। কারো গায়ে লাগলো না তার কনুই। কিশোর নেই ওখানে।
গেল কই? খোঁজ, খেজ। গোয়েন্দাপ্রধানের দেখা মিললো সিংহের খাঁচার পেছনে, কখন গেছে ওখানে খেয়ালই করেনি দুই সহকারী।
এখানে কি, কিশোর? জানতে চাইলো রবিন।
মুখে কিছু না বলে আঙুল তুলে ট্রেলারটা দেখালো কিশোর, তাঁবুর ভেতরেই থাকে ওটা, পর্দার অন্যপাশে। সিংহের ঘর। খেলা দেখানোর সময় খাঁচায় ঢেকে সিংহটা, অন্য সময় থাকে ট্রেলারটাতে ট্রেলার আর খাঁচা একসঙ্গে যুক্ত, মাঝে শিকের বেড়া। বেড়া সরিয়ে দিলেই ট্রেলার থেকে খাঁচায় চলে আসতে পারে ওটা, বাইরে দিয়ে আসার দরকার হয় না। ট্রেলারের দরজায় বড় তালা লাগানো থাকে। কড়া দেখালো কিশোর। ভালো করে দেখো, বুঝবে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে। জোর করে খোলা হয়েছে। ইচ্ছে করেই কেউ ছেড়ে দিয়েছিলো কিংকে।
.
০৫.
তখন থেকেই ভাবছিলাম, বেরোলো কি করে সিংহটা? বললো কিশোর। তাঁবুতে ঢুকে মনে হলো, যাই, দেখিই না। দেখলাম। কিন্তু কথা হলো, মারকাসের অগোচরে কে ছাড়লো কিংকে? তালাটা তুলে দেখালো সে। এই দেখো, চাবির ফুটোর চারধারে আঁচড়ের দাগ, নতুন। বেশিক্ষণ হয়নি খুলেছে।
তুমি শিওর, কিশোর? বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু কিশোরের কথা অবিশ্বাসও করতে পারছে না রবিন।
মাথা ঝাঁকালো কিশোর।
কে করলো কাজটা? মুসার প্রশ্ন।
তিনজনেই ভাবছে, এই সময় পর্দার ওপাশে জোর হাততালি শোনা গেল। খেলা শেষ। লাফাতে লাফাতে এসে ট্রেলারে ঢুকলো কিং।
উন্মাদের কাজ, রবিন বললো।
সিংহটার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। উন্মাদ? আমার তা মনে হয় না। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
যেমন? মুসা জানতে চাইলো।
হতে পারে, দর্শককে ভয় দেখিয়ে কারনিভল করা কিংবা সিংহ পাকড়াও করে হিরো সাজার ইচ্ছে। কিংবা লোকের নজর আরেকদিকে সরিয়ে দিয়ে ফাঁকতালে কোনো জরুরী কাজ সেরে ফেলা।
কিন্তু তেমন তো কিছু ঘটেনি, মুসা বললো।
হিরো সাজতেও আসেনি কেউ, বললো রবিন।
আসার সময়ই হয়তো দেয়নি মুসা। অথবা যে কাজটা সারতে চেয়েছিলো। সেই লোক, সেটার সুযোগ দেয়নি। থামিয়ে দিয়েছে সিংহটাকে।
কারনিভল বন্ধ করতে চাইবে কেন কেউ? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো রবিন। লোকের মারাত্মক ক্ষতি করে? সিংহ ছেড়ে দেয়া ছাড়া কি আর উপায় ছিলো না?