মুসার বাহু আঁকড়ে ধরলো কিশোর। ফিসফিস করে বললো, কথা বলবে না। আমাদের দেখেনি।
গর্জে উঠলো আবার কোহেন। এই, কথা শুনছি। বেরোও। বেরিয়ে এসো।
ওই যে, দরজা! দেখালো মুসা।
অনেকগুলো আয়নার মাঝে দরজাটা। কিশোরের হাত ধরে ওটা দিয়ে ঢুকে পড়লো মুসা। সরু একটা গলিপথে ঢুকলো ওরা, ছাত নেই। দশ কদম মতে গিয়ে দুভাগ হয়ে গেছে পথ। পেছনে কোহেনের কণ্ঠ আর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, দরজাটা দেখে ফেলেছে সে।
বাঁয়েরটা দিয়ে, কিশোর, তাড়া দিলো মুসা। জলদি!
আগে আগে চলেছে গোয়েন্দা-সহকারী। প্রতি দশ কদম পর পরই দুভাগ হয়ে যাচ্ছে পথ। প্রতিবারেই বাঁয়ের পথ ধরছে সে। পেছনে লেগে রয়েছে কোহেন, পায়ের শব্দেই বোঝা যায়।
অবশেষে আরেকটা দরজা পাওয়া গেল। ধাক্কা দিয়ে পাল্লা খুলে একটা ঘরে ঢুকলো ছেলেরা। তাজ্জব হয়ে গেল। আবার সেই আয়না ঘরে ফিরে এসেছে।
মরীচিকা! বিমূঢ়ের মতো বললো কিশোর। ফান হাউসের আরেক মজা! ছাগল বানিয়ে ছেড়েছে আমাদের, গলায় রশি দিয়ে একই জায়গায় ঘুরিয়েছে!
কোহেনও তো এসে পড়লো! গুঙিয়ে উঠলো মুসা।
ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। উপায় একটা নিশ্চয় আছে। আবার ওই দরজা দিয়ে ঢুকবো। এবার আর বয়ে যাবো না। ডানে।
আয়নাগুলোর মাঝের দরজা দিয়ে আবার সরু গলিতে ঢুকলো দুজনে। দশ কদম এগিয়ে সরে গেল ডানের পথটায়। পদশব্দ এখনও অনুসরণ করছে ওদের। পেছনে তাকানোর সময় নেই। ছুটছে তো ছুটছেই ওরা। ধীরে ধীরে কমে এলো পেছনের আওয়াজ, মিলিয়ে গেল একসময়। সামনে দেখা গেল একটা ডাবল ডোর। দ্বিধার সময় নেই। ঠেলে পাল্লা খুলে ফেললো মুসা।
দরজার অন্যপাশে বেরিয়ে এলো দুজনে। খোলা আকাশের নিচে ব্রেরিয়ে। এসেছে। একপাশে ফান হাউস, আরেক পাশে টানেল অভ লাভ-এর প্রবেশ পথ।
আহ, বাঁচলাম! জোরে নিঃশ্বাস ফেললো মুসা।
হ্যাঁ, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো কিশোর। কাজও হয়েছে। লোকটাকে চিনতে পেরেছি। গিয়ে এখন মিস্টার কনরকে বলতে পারবো, কোহেন…
মড়মড় করে ভেঙে গেল পুরনো পচা কাঠ। ফান হাউসের দেয়াল ফুড়ে বেরোলো ব্যায়ামপুষ্ট শক্তিশালী বলিষ্ঠ দেহটা। চাঁদের আলোয় বন্য হয়ে উঠেছে। চোখজোড়া, জ্বলছে। কোহেন!
.
১৭.
ছায়ার ভেতরে হুমড়ি খেয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। শ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছে। তাকিয়ে আছে কোহেনের দিকে।
এখনও দেখেনি, কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বললো কিশোর। তবে দেখে ফেলবে।
বেড়ার কাছেও যেতে পারবো না, মুসা বললো। পথ আগলে রয়েছে। কিন্তু যেতে না পারলে…
টানেল অভ লাভ। চলো।
কি হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো ওরা। ছায়ার অভাব নেই। লম্বা হয়ে পড়েছে। নাগরদোলার স্তম্ভগুলোর ছায়া। ওগুলোর মধ্যে রইলো ওরা, কোনো অবস্থাতেই আলোয় বেরোলো না। কোহেনের অলক্ষ্যে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো।
আর আসছে না, মুসা বললো।
আসবে। ও জানে, আমরা ওকে দেখে ফেলেছি। আমাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করবেই। টানেল থেকে বেরোনোর আরেকটা পথ বের করতে হবে আমাদের।
সরু খাল কেটে সুড়ঙ্গের ভেতরে পানি ঢোকানোর ব্যবস্থা হয়েছে। তরল সীসার মতো লাগছে ওই পানিকে। কিনার দিয়ে গেছে পথ। সেই পথ ধরে হেঁটে চললো দুজনে। অনেকখানি ভেতরে ঢুকে সরু একটা কাঠের পুল পাওয়া গেল। শেষ মাথায় কাঠের জেটি। একসময় অনেক নৌকা থাকতো ওখানে, এখন আছে শুধু একটা পুরনো দাঁড়টানা নৌকা।
কিশোর, মুখে বাতাস লাগছে।
লাগবেই। সামনে বোধহয় ভোলা। নিশ্চয় সাগর।
কাঠের ওপর চাপ পড়ার মচমচ শব্দ হলো। নরম সোলের জুতো পরা পায়ের চাপ। কেউ আসছে।
নড়ড়া মা! হুঁশিয়ার করলো কিশোর। একদম চুপ।
সরু পুলের ওপর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। অনেক ওপরে ছাতের একটা ফোকর দিয়ে চুঁইয়ে আসছে চাঁদের আলো, নড়াচড়া ওখানেই দেখা গেল।
উল্টোদিক দিয়ে নেমে আসবে! মুসা বললো।
ফিরে যাবো? নিজেকেই প্রশ্ন করলো কিশোর।
ওপরে ছায়ামূর্তিটাকে নড়তে দেখা গেল। পিস্তল কক করার নির্ভুল শব্দ কানে এলো দুজনের। আস্তে কিশোরের কাঁধে হাত রাখলো মুসা।
ফিরে গিয়ে বাঁচতে পারবো না, কিশোর বললো। যেদিক দিয়েই বেরোই, চাঁদের আলোয় দেখে ফেলবেই।
ওদের কাছাকাছিই রয়েছে নৌকাটা, জেটির সঙ্গে বাঁধা। সামনের দিকে ছড়িয়ে ফেলে রাখা হয়েছে মোটা ক্যানভাস। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে এগোলো ওরা। নৌকায় উঠলো। গায়ের ওপর টেনে দিলো ক্যানভাসটা। অন্ধকারে পড়ে রইলো চুপচাপ, নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয়।
সময় যাচ্ছে। মিনিটের পর মিনিট।
পুলে হালকা পায়ের আওয়াজ হলো। কাঠের সঙ্গে ধাতব কিছুর ঘসা লাগলো যেন, দেয়ালে লেগেছে বোধহয় লোকটার হাতের পিস্তল।
তারপর অনেক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই।
পূর্ণ নীরবতা।
খালের পানিতে দুলছে নৌকা। ঘষা খাচ্ছে জেটির সঙ্গে।
আবার নড়লো লোকটা। ছেলেদের প্রায় মাথার ওপর চলে এলো জুতোর চাপা শব্দ। জোরে জোরে কয়েকবার নাড়া খেলো নৌকা, যেন ধরে কঁকিয়ে দেয়া হচ্ছে। থেমে গেল একসময়। তারপর শুধুই দুলুনি।
ক্যানভাসের নিচে গুটিসুটি হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
আরও কয়েক মিনিট পেরোলো। নৌকার গায়ে ঢেউয়ের ছলাত-ছল ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
চলে গেছে! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।
জবাব দিলো না কিশোর।
আরও কিছুক্ষণ পর আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো, মুসা, জলদি কারনিভলে ফিরে যেতে হবে। রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে!