বেশিদূর যেতে পারেনি, কিশোর বললো। ভাগ হয়ে খুঁজবো আমরা। নাগরদোলা ঘুরে আমি আর মুসা যাবো ডানে। রবিন, তুমি আর রবি যাও বুয়ে।
এই লোকটাই ডাকাত? রবি প্রশ্ন করলো।
মনে হয়। বেড়ালের ভেতর পায়নি, তাই ট্রেলারে খুঁজছিলো। পেয়ে গিয়ে থাকলে ও এখন মহাবিপজ্জনক। সাবধান, ধরার চেষ্টা করবে না। পিছে পিছে গিয়ে শুধু দেখবে, কোথায় যায়।
বাঁয়ে সুড়ঙ্গের দিকে চলে গেল রবি আর রবিন। মুসা আর কিশোর এগোলো ফান হাউসের হাসিমুখের দিকে।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল মুসা। কিশোর, শব্দ শুনলাম!
স্তম্ভগুলোর নিচে অন্ধকার। সেখান থেকেই এলো শব্দটা। আবার। কাঠের ওপর ভারি জুতোরঘষা লাগার মতো। তারপর, দ্রুত দূরে সরে গেল চাপা পদশব্দ।
দেখেছি, ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। ফান হাউসে ঢুকলো।
কে, চিনেছো?
না।
জলদি চলো। বেরোনোর আরও পথ থাকতে পারে।
মুসা দেখেছে, ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে গিয়ে ঢুকছে লোকটা। ওরা যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে ফান হাউসের মুখ পর্যন্ত একটুকরো খোলা জায়গা, চাঁদের আলোয় আলোকিত। একছুটে জায়গাটা পেরোলো ওরা। ভেতরে ঢুকে কান পাতলো। সরু বারান্দার মতো একটা জায়গা। ছাতের ফুটো দিয়ে আলো আসছে, অন্ধকার কাটেনি তাতে।
সামনে ছাড়া পথ নেই, কিশোর।
মুসার কথার সমর্থনেই যেন মচমচ শোনা গেল। তার পরেই ধুপ, সবশেষে তীক্ষ্ণ চিৎকার। গড়িয়ে পড়ে কাঠের দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে যেন ময়দার বস্তা। আবার শোনা গেল মচমচ, আবার ধুপ, তারপর নীরবতা।
অস্বস্তিতে পড়েছে দুই গোয়েন্দা। পা টিপে টিপে এগোলো আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে। একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
সাবধানে খুলবে, কথা শেষ করতে পারলো না গোয়েন্দাপ্রধান। মচমচ করে সামনে ঝুঁকে গেল বারান্দাটা। কাত হয়ে গেছে মেঝে। চিত হয়ে পড়লো দুজনে, গড়াতে শুরু করলো।
পাগলের মতো হাত বাড়াচ্ছে ওরা, ধরার মতো যদি কিছু মেলে। কিছুই নেই।
ধুপ করে কাঠের দেয়ালে বাড়ি খেলো মুসা। আঁউক করে উঠলো। পরক্ষণেই তার গায়ের ওপর এসে পড়লো কিশোর।
হাত-পা ছুঁড়ে কোনোমতে উঠে বসলো দুজনেই। হতবাক হয়ে দেখলো, কাত হয়ে যাওয়া মেঝে উঠে যাচ্ছে আবার। জায়গামতো লেগে ছাত হয়ে গেল। মাথার ওপর।
পুরো মেঝেটা কাত হয়ে গিয়েছিলো! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। নিশ্চয় কোনো কিছুর ওপর ব্যালান্স করা। একটা বিশেষ জায়গায় এসে কেউ দাঁড়ালেই কাত হয়ে যায়।
হ্যাঁ, অনেকটা টেকির মতো। ফান হাউসের মজার কৌশল। ডাকাতটাও নিশ্চয় আমাদের মতোই পড়েছে। গেল কোথায়?
পথ একটাই।
ঘরের দেয়ালে একটা বড় ফোকর দেখা যাচ্ছে। পাইপের মুখের মতো।
হামাগুড়ি দিয়ে ওটার দিকে এগোলো মুসা।
খেয়াল রেখো, পেছন থেকে কিশোর বললো। ওর মধ্যেও কৌশল থাকতে পারে।
ছোট সুড়ঙ্গ। আরেকটা ঘরে বেরিয়ে এলো ওরা। ছাতের ফাটল দিয়ে আলো আসছে।
ছাতই তো! নাকি মেঝে? অবাক হয়ে ভাবলো মুসা। কিশোওওওর! কেঁপে উঠলো গলা।
আবছা আলোয় মনে হলো ওদের, একটা উল্টে থাকা ঘরে রয়েছে। ছাত নিচে, মেঝে ওপরে। মেঝেতে রাখা চেয়ার, টেবিল, কার্পেট, সব উল্টো হয়ে আছে মাথার ওপরে। ওদের পায়ের কাছ থেকে সামান্য দূরে উল্টো হয়ে রয়েছে। একটা ঝাড়বাতি, বাহু নেই। দেয়ালে ঝুলছে ছবি, উল্টো।
ফিসফিস করলো বিস্মিত কিশোর, আরেকটা কৌশল, মুসা। আলো থাকলে আরও ভালোমতো দেখা যেতো।
আমরা সত্যি উল্টো হয়ে নেই তো? মুসার সন্দেহ যাচ্ছে না।
না।…ওই যে, আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ। এসো।
প্রথমটার চেয়ে এটা লম্বা। নড়েচড়ে, দোল খায়। ওরা বুঝলো, একসময় ওটাকে ঘোরানোর ব্যবস্থা ছিলো। এখন ঘোরে না যদিও, স্থিরও থাকে না। একজায়গায়। আরেক মাথায় বেরিয়ে, নামার সময় আরেকটু হলেই পড়ে। গিয়েছিলো কিশোর। সোজা হয়েই বললো, শুনছো?
সামনে কোনোখান থেকে আসছে শব্দটা, হালকা পা ফেলছে কেউ। ওদিকে! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা, পর মুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠলো, ওরিবাবারে…!
লম্বা-চওড়ায় আগেরটার চেয়ে বড় এই ঘর। ছাতে অসংখ্য গর্ত, ফাটল, বেশ ভালো আলো আসছে। মুসার মনে হলো গভীর সব ছায়া নড়ছে। কিন্তু ছায়ার। কারণে ভয় পায়নি সে। যা দেখালো, সেটা দেখে কিশোরও ঢোক গিললো।
ডানে দেয়ালের কাছে নড়ছে একটা অদ্ভুত মূর্তি। সোজা তাকিয়ে আছে ছেলেদের দিকে। লম্বা, পাকাটির মতো:শরীর, তার ওপর বিশাল এক মাথা। হাত দুটো সরু সরু, যেন মাকড়সার শুড়। কিভূত এক মানব-সর্প যেন, ভাসছে রুপালি চাঁদের আলোয়।
কী-কী ওটা, কি-কিশোর! কাছে ঘেঁষে এলো মুসা। ভূউত না তো?
আরেকবার ঢোক গিললো কিশোর। আ-আমি জানি নাঃ..আমি…, হঠাৎ হাসতে শুরু করলো সে। মুসা, ও কিছু না। আয়না। আয়না ঘরে ঢুকেছি আমরা। বিভিন্ন ভঙ্গিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাকা আয়নাগুলো।
আয়না? তাহলে পায়ের আওয়াজ শুনলাম কেন?
আমি…. শুরু করেই বাধা পেলো কিশোর।
ও-ওটাও কি আয়না? জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে মুসা
নাক বরাবর সামনে, আয়না থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি। কান। পেতে রয়েছে যেন। চওড়া কাধ কোমর পর্যন্ত নগ্ন, লম্বা অগোছালো কালো চুল, কালো দাড়ি, চাঁদের আলোয় বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কোহেন! যথাসাধ্য চেষ্টা করেও কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখতে পারলো না মুসা। শুনে ফেললো কোহেন। পাঁই করে ঘুরলো। এই, এই, বেরিয়ে এসো।