না তো! সারাদিনই দেখিনি। কিছু হয়েছে?
বুঝতে পারছি না। আমি…
মুসা, হাত তুললো বোরিস। কিসের আওয়াজ? ভোমরা ঢুকেছে নাকি তোমার পকেটে?
উত্তেজিত না থাকলে আগেই খেয়াল করতো মুসা। বোলতায় কামড়ালো যেন তাকে। ঝট করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো যন্ত্রটা। সিগন্যাল! চেঁচিয়ে উঠলো সে, বোরিসভাই, বিপদে পড়েছে ওরা! জলদি চলুন।
একটাও প্রশ্ন করলো না আর বোরিস। প্রায় লাফিয়ে গিয়ে উঠলো ট্রাকের ড্রাইভিং সীটে। সাইকেল রেখে মুসা গিয়ে বসলো তার পাশে। ইয়ার্ডের গেট দিয়ে। ছুটে বেরোলো ট্রাক।
মুসার হাতে হোমার। দিকনির্দেশ করছে কাঁটা। পথ বাতলে দিতে লাগলো বোরিসকে, বায়ে, বোরিসভাই…আবার বায়ে…এবার সোজা…
পথের ওপর বোরিসের দৃষ্টি, মুসার নজর যন্ত্রের ডায়ালে। উড়ে যেতে পারলে যন্ত্রের কাটা একদিকেই নির্দেশ করতো। যেহেতু মাটি দিয়ে যেতে হচ্ছে, পথ সরাসরি যায়নি, ঘোরাঘুরি হচ্ছে, ফলে কাটাও একবার ডানে, একবার বায়ে সরছে।
বলে যাচ্ছে মুসা, ডানে, বোরিসভাই–বাঁয়ে…আবার বায়ে…এবার ডানে!
ধীরে ধীরে বাড়ছে যন্ত্রের শব্দ।
এখানেই! মুসা বললো। কাছাকাছিই হবে কোথাও!
নির্জন একটা পথে এসে পড়েছে ট্রাক। এই সন্ধেবেলা একটা লোককেও দেখা গেল না রাস্তায়। ধীরে চালাচ্ছে এখন বোরিস। মুসার নজর পথের দুপাশে। কাউকে দেখলো না, কোনো নড়াচড়া নেই। আবার তাকালো কাঁটার দিকে।
ডানে, বোরিসভাই। এখানেই আছে কোথাও।
কিছু তো দেখছি না, মুসা! উদ্বেগে ভরা বোরিসের কণ্ঠ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। পিছে, পেছনে যান! বেশি এগিয়ে। গেছি!
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো বোরিস। ট্রাকটা পুরোপুরি নিশ্চল হওয়ার আগেই ব্যাক-গীয়ার দিলো। বিকট শব্দে প্রতিবাদ জানালো ইঞ্জিন, পিছাতে শুরু করলো গাড়ি।
পথ থেকে দূরে ছোট হঁটের বাড়িটা দেখালো মুসা। বোরিসভাই, আমার মনে হয় ওখানে।
গাড়ি পার্ক করে লাফ দিয়ে নামলো বোরিস। মুসাও নামলো। বাড়িটার দিকে দৌড় দিলো দুজনে।
.
কয়েক মিনিট পর, হাসিমুখে বেরিয়ে এলো কিশোর, রবিন আর রবি। দরজা ভেঙে ফেলেছে বোরিস আর মুসা মিলে।
খাইছে! হেসে বললো মুসা। কিশোর, তোমার দিনি…দিনি…
দিনিজসপ্রে।
হ্যাঁ। দিনি…দিনি… বাংলা শব্দটা কিছুতেই উচ্চারণ করতে না পেরে রেগে গেল মুসা।
ধ্যাত্তোর, নিকুচি করি দিনিফিনির! সহজ নাম রাখো।…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, হোমারটা সত্যি কাজে লাগলো। এতো তাড়াতাড়ি…
এই, কে তোমরা! ধমকের সুরে বলে উঠলো কেউ।
ফিরে তাকালো ওরা। রাস্তার দিক থেকে আসছে ছোটখাটো একজন মানুষ। কাছে এসে আবার ধমক দিলো, এখানে কি? হায় হায়রে,আমার দরজা-টরজা সব ভেঙে ফেলেছে! আদালতে পাঠাবো আমি তোমাদেরকে! জেলের ভাত খাওয়াবো!
লোকটার মুখোমুখি হলো কিশোর। শান্তকণ্ঠে বললো, সরি স্যার, ইচ্ছে করে ভাঙিনি। একটা বাজে লোক আমাদের এখানে এনে বন্দি করেছিলো। বাইরে থেকে। তালা লাগিয়ে চলে গেল। বহুত চিল্লাচিল্লি করেছি, কেউ শোনেনি। লোকটার হাতে টাট্টু আঁকা, পাল-তোলা-জাহাজের ছবি, কালো চামড়া। কোন দেশী, বলতে পারবো না। চেনেন? আপনার ভাড়াটে?
আটকে রেখেছে? টাট্টু? কি বলছো তুমি, ছেলে? বৃদ্ধ বললো। আজ সকালে এক ভদ্রলোককে ভাড়া দিয়েছি। দেখে তো সহজ-সরল মানী লোক মনে হলো। বুড়ো মানুষ। কোথায় নাকি সেলসম্যানের চাকরি করে। টাট্ট তো দেখিনি! যা-ই হোক, ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছে। পুলিশে রিপোর্ট করবো আমি।
হ্যাঁ, তাই করুন, স্যার। পুলিশকেই জানানো দরকার। দেরি না করে এখুনি। যান, প্লীজ।
মাথা ঝাঁকালো লোকটা। দ্বিধা করলো, ঘুরে আবার ফিরে চাইলো, তারপর আবার ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো রাস্তার দিকে।
লোকটা কিছুদূর এগিয়ে গেলে কিশোর বললো, চলো, আমরাও যাই। তাড়াতাড়ি করলে এখনও হয়তো ধরা যায় ব্যাটাকে। বোরিসভাই, চব্বিশ নম্বর। কেলহ্যাম স্ট্রীট। কুইক!
.
১৩.
সাগরের ধারে পুরনো, বড় বড় সব বাড়ি। পথের দুধারে গাছপালা, কড়া রোদেও নিশ্চয় ছায়া থাকে। নীল গাড়িটা দেখলো না ছেলেরা।
জানতাম, ব্যাটাকে ধরা যাবে না, নিরাশ কণ্ঠে বললো মুসা।
হ্যাঁ, অনেক দেরি করিয়ে দিলো, সুর মেলালো মুসা।
কোনো কারণে ওর দেরি হলেই বাঁচি, আশা করলো, কিশোর। পথের। মাথায়, ওই বাড়িটাই বোধহয় চব্বিশ নম্বর। ইস, অন্ধকারও হয়ে যাচ্ছে। যান। এগোন।
তিনতলা সাদা একটা বাড়ি। চারপাশে বড় বড় গাছ। বাগানে ফুলের বেড। ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি, সেই নীল গাড়িটা নয়। মোড় নিয়ে সেদিকে চললো। বোরিস, এই সময় আলো জ্বললো বাড়ির ভেতরে।
এইমাত্র এলো? কিশোর তাকিয়ে আছে সেদিকে, লোকজন কে আছে দেখতে চায়। এর
বাড়ির সামনে এনে গাড়ি রাখলো বোরিস।
মহিলাকণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল বাড়ির ভেতর থেকে, চোর! চোর। ধরো! ধরো!
এক ঝটকায় ট্রাকের দরজা খুলে লাফিয়ে নামলো বোরিস।
ছেলেরাও নামলো হুড়াহুড়ি করে। মুসা চেঁচিয়ে বললো, নিশ্চয় টাট্টুওলা!
দৌড় দিয়েছে বোরিস.। পেছনে ছেলেরা ছুটলো।
একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চলেছেন মহিলা।
দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল মুসা। হাত তুলে দেখালো বাড়ির একপাশে। আবছা অন্ধকারে সবাই দেখলো, খাড়া দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে। একজন মানুষ। কি ধরে নামছে, সে-ই জানে। কয়েক ফুট বাকি থাকতে লাফিয়ে পড়লো মাটিতে, জানালা দিয়ে আসা আলোর মাঝে। কোনো ভুল নেই, সেই লোকটা। বগলে লাল-কালো ডোরাকাটা কানা বেড়াল।