লিভিং রুমের জানালার পাল্লায় ঠেলা দিতেই খুলে গেল। এক এক করে। চৌকাঠে উঠে টপাটপ ভেতরে লাফিয়ে পড়লো তিনজনে।
ফোনটা কোথায় দেখো! তাগাদা দিলো কিশোর। সবখানে খোজো!
ওই যে, কিশোর, হাত তুলে দেখালো রবি। ওই যে, ঘরের কোণে মেঝেতে রেখে দিয়েছে।
ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো কিশোর। ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো। আস্তে করে আবার ক্রেডলে রেখে দিয়ে মাথা নাড়লো। নষ্টহ্! ফেস করে ছাড়লো ফুসফুঁসে চেপে রাখা বাতাস।
হলো না তাহলে? রবিন বললো।
জানি না, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। সাইকেল নিয়ে যেতে পারি-লাভ হবে বলে মনে হয় না। বাড়িতে লোক না থাকলে অবশ্য…
না থাকলে কি বসে থাকবে মনে করেছো? তালা ভেঙে ঢুকে নিয়ে যাবে।
কাছেপিঠে পাবলিক টেলিফোন নেই? রবি জিজ্ঞেস করলো।
গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। তাই তো! আমার মগজ ভোঁতা…, কথা শেষ না করেই থেমে গেল।
বাইরে পায়ের শব্দ, এগিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলো রবিন। ঝট করে মাথা নুইয়ে ফেললো আবার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে জানালো, লোকটা ফিরে এসেছে!
চলো বেরিয়ে যাই, উদ্বিগ্ন হয়ে বললো রবি।
সময় নেই, মৃদু কাঁপছে রবিনের কণ্ঠ।
আঙুল তুলে দরজা দেখালো কিশোর, পেছনের ঘরে ঢোকার। দৌড়ে গিয়ে ঢোকার সময় ধাক্কাধাক্কি লাগিয়ে দিলো ওরা। আগে ঢুকলো রবি, পেছনে রবিন, সবার শেষে কিশোর। ছোট ঘর। আসবাবপত্র কিছু নেই। জানালায় খড়খডির। জন্যে আলো আসতে পারছে না। তাড়াতাড়ি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ওটা ঘেঁষে। দাঁড়ালো ওরা।
লিভিং রুমের দরজা খোলার শব্দ হলো, বন্ধ হলো।
দীর্ঘ নীরবতা।
তারপর ছেলেদের চমকে দিয়ে খলখল করে হেসে উঠলো লোকটা। খসখসে গলায় বললো, খুব চালাক, না? অতি চালাকের গলায় দড়ি, ভুলে গেছো!
একে অন্যের দিকে তাকালো ওরা।
আবার শোনা গেল হাসি। তিন-তিনটে মাথা জানালায়, ভেবেছো দেখিনি? আরও সাবধানে উঁকি দেয়া উচিত ছিলো। তোমাদের অনেক আগে দুনিয়ায়। এসেছি, বাছারা, চোখ পেকেছে, কান পেকেছে। তিন বুদু, বোকামির শাস্তি পাবে এখন।
দরজায় তালা লাগানোর শব্দ হলো। তারপর আরেকটা ভারি ধাতব শব্দ, লোহার দণ্ড আড়াআড়ি ফেলে পাল্লা আটকানো হয়েছে, যাতে তালা ভাঙলেও দরজা খুলতে না পারে। নাও, থাকো এখন, বললো খসখসে কণ্ঠ। একটা কথা মনে রেখো। আর আমার ধারেকাছে আসবে না। হাসলো না আর। দূরে সরে গেল পদশব্দ। দড়াম করে বন্ধ হলো সামনের দরজা। ভারি নীরবতা যেন চেপে বসলো ছোট্ট বাড়িটার ওপর।
জানালা, বললো কিশোর। গিয়ে খড়খড়ি তুলেই থমকে গেল। শিক লাগানো। বিড়বিড় করলো, নিশ্চয় এটা ঘড়ি মেকারের স্টোররুম ছিলো!
জানালা খুলে চেঁচাই, রবিন বললো।
গলা ফাটিয়ে চেঁচালো ওরা। কেউ শুনলো না। কেউ এলো না। রাস্তা অনেক দূরে, বাড়িঘর আরও দূরে। ওদের চিৎকার কারও কানে গেল না। কয়েক মিনিট পর পা ছড়িয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো রবি। জানালা খোলায় ঘরে আলো এসেছে। এই প্রথম. চোখে পড়লো আরেকটা দরজা।
ছুটে গেল কিশোর। লাভ হলো না। ওটাও শক্ত করে আটকানো, তালা দেয়া।
আমাদের দৌড় এখানেই শেষ, হতাশ কণ্ঠে বললো রবি। বেড়ালটা নিয়ে যাবে সে। আটকাতে পারবে না।
এখনও আশা আছে, বলে উঠলো কিশোর। দিনিজসপ্রে! মুসা আমাদের বিপদ সঙ্কেত পাবে।
পকেট থেকে খুদে হোমারটা বের করলো গোয়েন্দাপ্রধান। মুখের কাছে এনে জোরে জোরে বললো, সাহায্য! সাহায্য!
খুব মৃদু গুঞ্জন শুরু করলো যন্ত্রটা।
লাল আলো জ্বলবে এখন মুসার হোমারে, বললো কিশোর। সত্যিই শুনবে তো–তিনজনে একই কথা ভাবছে। সাহায্য করতে আসবে ওদেরকে?
.
ডাণ্ডার ওপরই বসে আছে মুসা। পর্বত থেকে আসা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস সুচের মতো বিধছে চামড়ায়। কাপ তুলে দিচ্ছে গায়ে। আকাশ মেঘলা থাকায় সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা নামছে। প্রবেশ পথের লোকজন এখন শুধু ছায়া।
যারা যারা বেরিয়েছে, তাদের একজনকেও ফিরতে দেখেনি। অথচ কারনিভলে শো শুরু হতে আর মাত্র ঘন্টাখানেক বাকি। গেল কোথায় সবাই? কিশোর, রবিন আর রবিই বা কোথায় গেল? কারনিভল খোলার আগেই তো রবির ফেরার কথা। কিশোর বা রবিনেরও এতো দেরি করার কথা নয়, অন্তত একটা মেসেজ তো পাঠানো উচিত ছিলো।
উদ্বিগ্ন হলো মুসা।
মাঝে মাঝে কিশোর এমন আচরণ করে, না, রাগ লাগে তার। কোথায় যাচ্ছে, বলে গেলে কি ক্ষতি হতো বাবা? না, সব কাজ শেষ করে, সফল হয়ে এসে তারপর বলা! যত্তোসব! তার এসব নাটকীয়তার কারণে আগে অনেকবার বিপদে পড়েছে তিন গোয়েন্দা, তা-ও স্বভাব বদলাতে পারে না। গিয়ে খোঁজ করবে?
করাই উচিত। মাটিতে নামলো মুসা। ফান হাউসের বিশাল মুখটা তার দিকে চেয়ে যেন ব্যঙ্গ করে হাসছে এই ভর সন্ধেবেলা। দ্রুত ওটার পাশ কাটিয়ে এসে মাথা গলিয়ে দিলো বেড়ার ফোকরে।
কারনিভলে নাগরদোলার ঘোড়াগুলোর ক্যানভাস সরানো হয়েছে। বাজনা বাজছে। বুদে পাওয়া গেল না রবিকে। ঠোঁট কামড়ালো মুসা। কোথায় গেছে? কানা বেড়াল কেনার বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে, তার বাড়িতে দুজনকে নিয়ে যায়নি তো কিশোর? কিন্তু তাহলেও কি এতো দেরি করার কথা?
হয়তো জরুরী কোনো কাজে আটকে গেছে, মনকে বোঝালো মুসা। আসবে। কারনিভল খোলার আগেই চলে আসবে। আর এসেই প্রথমে মুসাকে খুঁজবে, তার রিপোর্ট শুনতে চাইবে। তাকে না পেলে চিন্তা করবে…