মাথার অনেক ওপরে উঠে গেছে স্তম্ভগুলো, কালচে ধূসর আকাশ ছুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে যেন। স্তম্ভ আর বেড়ার মাঝের পোড়ো ফান হাউসটাকে কেমন ভূতুড়ে লাগছে। ওটার প্রবেশ পথ দেখে মনে হয়, মস্ত দৈত্যের হাঁ করা মুখে রঙ মাখিয়ে দিয়েছে। কেউ হাসছে নীরব হাসি। ডানে, সাগরের ধারে লাশ হয়ে পড়ে আছে বুঝি টানেল অভ লাভ। মানুষের তৈরি ওই সুড়ঙ্গের দেয়ালে অসংখ্য ফোকর। সরু মুখের কাছে গড়িয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ, একসময় ওখানে বাধা থাকতো অনেক নৌকা, টিকেট কেটে লোকে চড়তো ওগুলোতে, ঘুরে আসতো সাগর থেকে।
বড় একা লাগছে মুসার। সতর্ক হয়ে উঠলো হঠাৎ। কারনিভলের গেট দিয়ে। লম্বা লম্বা পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একজন। রকি বীচের বাণিজ্যিক এলাকার দিকে চলে গেল লোকটা। চেনা চেনা লাগলো তাকে। পরনে ধোপদুরস্ত শহুরে পোশাক, দূর থেকে ম্লান আলোয় চিনতে পারলো না লোকটাকে মুসা।
কোহেন না তো? চওড়া কাঁধই তো, নাকি? দাড়িও আছে না মুখে? তবে এলোমেলো লম্বা চুল দেখা গেল না, হ্যাঁটের জন্যেই বোধহয়। পরনে কালো সোনালি পাজামাও নেই, কাজেই শিওর হতে পারলো না মুসা।
খানিক পরেই আরেকজনকে বেরোতে দেখা গেল। লম্বা। ওকেও চেনা চেনা লাগলো, কিন্তু চিনতে পারলো না মুসা। সান্ধ্য পোশাক পরে মারকাস দ্য হারকিউলিস গেল না তো?
দমে গেল মুসা। পঞ্চাশ-ষাট গজ অনেক দূর। এতো দূরে বসা উচিত হয়নি। পোশাক বদলে বেরোলে এখান থেকে দেখে কারনিভলের একজন কর্মীকেও চিনতে পারবে না সে। স্থান নির্বাচন যে ভুল হয়ে গেছে, নিশ্চিত হলো আরও দুজন বেরোনোর পর। তৃতীয়জনও লম্বা, মনে হলো বয়স্ক, ধূসর চুল। চতুর্থজনকে চিনতে পারলো শুধু মাথার টাকের জন্যে, আগুন খেকো। তবে চতুর্থ লোকটার ব্যাপারেও কিছুটা সন্দেহ রয়ে গেল। টাকমাথা আর কি কেউ থাকতে পারে না?
নেমে, জায়গা বদল করে বসবে কিনা ভাবতে ভাবতেই আরও অনেকে। বেরিয়ে গেল। নিশ্চয় রিহারস্যালের সময় শেষ। বাইরে বেরোচ্ছে তাই কারনিভলের লোকেরা। ওদেরকে চিনতে পারলেও খুব একটা লাভ হতো না, বুঝতে পারলো মুসা। অনেকেই তো বেরোচ্ছে। কজনকে সন্দেহ করবে?
অবশেষে সত্যি সত্যি একজনকে চিনতে পারলো। মিস্টার কনর। দ্রুত হেঁটে গিয়ে একটা ছোট গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।
নড়েচড়ে বসলো মুসা। ভাবছে। নামবে? গিয়ে খুঁজে বের করবে বন্ধুদের? নাকি যেখানে আছে, বসে থাকবে আরও কিছুক্ষণ?
সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
বাতাস বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পুরনো নাগরদোলার ক্যাঁচকোঁচ আর গোঙানি।
.
১০.
আগে আগে চলেছে কিশোর। দুই সঙ্গীকে নিয়ে যাচ্ছে স্যালভিজ ইয়ার্ডে।
ইয়ার্ডে ঢুকে, ওদেরকে দাঁড়াতে বলে সাইকেল রেখে গিয়ে জঞ্জালের গাদায়। ঢুকলো সে।
সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জঞ্জালের ভেতর জিনিসপত্র ঘাঁটা আর ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ শুনতে লাগলো ররিন আর রবি।
করছেটা কি? রবি বুঝতে পারছে না।
জানি না, রবিনও পারছে না। আগে থেকে কিছু বলতে চায় না কিশোর, স্বভাব। কাজ শেষ করে তারপর বলে। কি করছে সে-ই জানে।
দুড়ুম-দাডুম আওয়াজ হচ্ছে জঞ্জালের গাদায়। রেগে গিয়ে সব যেন ছুঁড়ে ফেলছে কিশোর। অবশেষে শোনা গেল উল্লসিত চিৎকার, হাসিমুখে বেরিয়ে এলো সে-। হাতে একটা অদ্ভুত জিনিস। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললো, জানতাম পাবো। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে সব মেলে।
কিশোর কাছে এলে জিনিসটা চিনতে পারলো অন্য দুজন। স্টাফ করা একটা বেড়াল। সাদার ওপর কালো ফোঁটা। তিনটে পা ছিঁড়ে ঝুলছে, একটা নেই-ই। একটা চোখ খসে পড়েছে। চামড়া ফেটে ভেতরের তুলা-ছোবড়া সব বেরিয়ে পড়েছে।
এটা দিয়ে কি হবে? রবি জিজ্ঞেস করলো!
বিজ্ঞাপনের জবাব দেবো, হাসি-চওড়া হলো কিশোরের।
কিন্তু ওটা তো কানা বেড়ালের মতো না! হাত নাড়লো রবিন।
না তো কি হয়েছে? হয়ে যাবে। এসো।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো ওরা। ছোট একটা ওয়ার্কবেঞ্চে বসলো কিশোর। ফিরে চেয়ে বললো, রবিন, ফোন করে জিজ্ঞেস করো তো, কোথায় যেতে হবে।
রবিন রিসিভার তোলার আগেই কাজে হাত দিলো কিশোর। রঙ, ব্রাশ, সুই সুতো, কাপড়, তুলা, তার, আর দ্রুত রঙ শুকানোর কেমিক্যাল বের করলো। তিনটে পা মেরামত করে সেলাই করলো জায়গামতো, নতুন আরেকটা পা বানিয়ে লাগালো, শরীরের ছেঁড়া জায়গা সেলাই করলো। টিপে, চেপে বাঁকা করলো বেড়ালটাকে। পা-গুলো বকিয়ে দিলো। তারপর রঙ করতে শুরু করলো।
ফোন শেষ করে ফিরে এলো রবিন।
কি বললো? মুখ তুললো না কিশোর, বেড়ালের গায়ে ব্রাশ ঘষছে।
একটা আনসারিং সার্ভিসের নাম্বার ওটা, রবিন জানালো। তেত্রিশ স্যান। রোকুইওয়েতে যেতে বললো। এখান থেকে মাত্র দশ বুক দূরে।
গুড। অনেক সময় আছে। অ্যানসারিং সার্ভিসের সাহায্য নিয়েছে, তার কারণ, বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় লোকটার কোনো ঠিকানা ছিলো না।
আধ ঘন্টা পর সন্তুষ্ট হয়ে ব্রাশ রাখলো কিশোর। একটা কলারে লাল রঙ করে পরিয়ে দিলো বেড়ালের গলায়। ব্যস, হয়েছে, লাল-কালো ডোরাকাটা কানা। বেড়াল। পা ঠিকমতো বাকা হয়েছে তো? হয়েছে। তবু, চোখ থাকলে চিনে। ফেলবে। কাজ চালানো যাবে আশা করি।
আমার কাছেও রবির বেড়ালের মতো লাগছে না, রবিন বললো।
না লাগুক। গিয়ে অন্তত দেখাতে পারবো, বেড়াল এনেছি।