কি সাংঘাতিক! ঊরুতে চাপড় মারলো রবি। হয়তো ঠিকই বলেছো। সন্দেহ যাচ্ছে না তার। মেনে নিতে পারছে না।
আমি জানি আমি ঠিক বলছি, ঠোঁটের এক কোণ কুঁচকালো কিশোর। শিওর হচ্ছি লোকটার অপেক্ষার ধরন দেখে। কাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে সে, চুরি। করার জন্যে। কারনিভলের লোক বলেই সাবধান হতে হয়েছে তাকে, আর কারনিভলের লোক বলেই সময় নষ্ট করার ঝুঁকি নিতে পেরেছে। ঠিক সময়টা বেছে নিয়েছে, যখন বেড়াল করলে কারও সন্দেহ পড়বে না তার ওপর। কারনিভলের কারও পক্ষেই শুধু রবির ওপর সারাক্ষণ চোখ রাখা সম্ভব, ঝোপ বুঝে কোপ মারা সম্ভব। তবে কোপ মারতে বেশি দেরি করে ফেলেছে।
এই না বললে ঠিক সময়? মুসা ধরলো কথাটা।
কাজটা করেছে ঠিক সময়ই, তবে বেশি দেরি করেছে আরকি।
বুঝলাম না।
বুঝলে না? রকি বীচে আসার আগে বেড়ালগুলোকে ফার্স্ট প্রাইজ হিসেবে চালানোর কথা ভাবেনি রবি। আর কিছু না পেয়েই ওগুলোকে চালিয়েছে। পয়লা রাতেই পার করে দিয়েছে চারটে। তাতে চমকে গেছে চোরটা। সে ভাবেওনি এরকম কিছু একটা করে বসবে রবি। চারটে চলে যাওয়ার পর আর ঝুঁকি নিতে চায়নি চোর, তাড়াহুড়ো করেছে, যাতে পঞ্চমটাও হাতছাড়া না হয়ে যায়। দেরি করে করেছে বললাম এই জন্যে, আগের দিন চেষ্টা করলে চারটে না হোক, অন্তত আরও দুএকটা বেড়াল সে হাতাতে পারতো। পঞ্চমটাও ছুটে যাচ্ছে দেখে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে, সিংহ ছাড়তেও দ্বিধা করেনি।
মুসার কাছে কিংকে নিয়ে যেতে হয়েছে, রবি বললো। যদি সত্যিই নিয়ে গিয়ে থাকে। আর তা করতে হলে করেছে এমন কেউ, যাকে কিং চেনে।
মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে, সন্দেহ নেই, কিশোর বললো। তবে সফল হয়েছে। একটা বেড়াল অন্তত নিতে পেরেছে। এখন বিজ্ঞাপন দিয়েছে বাকিগুলোর জন্যে। হয় মুসার বেড়ালটা সঠিক বেড়াল নয়, যেটা সে খুঁজছে, নয়তো সবগুলোই তার দরকার।
মাথা দোলালো রবিন। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। হঠাৎ করে। বেড়ালগুলো দামি হয়ে উঠেছে, একথা বললে কেন?
কারণ, স্যান মেটিওতে আগুন লাগার আগে ওগুলো নেয়ার চেষ্টা করা হয়নি। হতে পারে, আগুন লাগানোই হয়েছে বেড়ালগুলো নেয়ার জন্যে। পারেনি। রবি, স্যান মেটিওতে শুটিঙের সময় বের করেছিলে ওগুলো?
কয়েকটা। এমনি লোককে দেখানোর জন্যে। শো-কেসে সাজিয়ে রেখে ছিলাম। প্রাইজ দেয়ার ইচ্ছে ছিলো না।
কিশোর, রবিন বললো। তুমি বললে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো চোর। স্যান মেটিওতেই যদি নেয়ার চেষ্টা করে থাকে, তোমার যুক্তি গোলমাল হয়ে যাচ্ছে না?
মোটেই না। আমি বলেছি, ঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো সে। হয়তো স্যান মেটিওতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আরেকটা ভালো সুযোগের জন্যে বসেছিলো। তবে। আগুন লাগার অন্য কারণও থাকতে পারে। সেই কারণটাই জানার চেষ্টা করবো। জানতে হবে, কেন, কে চায় কানা বেড়ালগুলো?
কি করে সেটা জানবো? মুসার প্রশ্ন।
ভাবলো কিশোর। তুমি থাকবে। এমন কোথাও, যেখানে বসে কারনিভল থেকে কে কে বেরোয় সব দেখতে পাবে। তোমাকে যেন না দেখে।
আমার ওপরই এই গুরুদায়িত্ব?
আবারও বলছি, চোর এই কারনিভলেরই লোক, মুসার কথা কানে তুললো কিশোর। একশো ডলার কম না, লোকে সাড়া দেবেই। বেড়াল আনার জন্যে বেরোতেই হবে চোরকে। অবশ্য তার কোনো সহকারী না থাকলে। নেই বলেই মনে হয় আমার। একাই করছে যা করার। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়তে পারে। তোমার। রবিন, দিনিজসপ্রেটা দিয়ে দাও ওকে। আমারটা আমার কাছেই থাক।
যাচ্ছো নাকি কোথাও? রবি জিজ্ঞেস করলো। আমি আসবো?
তা আসতে পারো। জলদি জলদি করতে হবে আমাদের।
কোথায় যাচ্ছো তোমরা? আমাকে একা ফেলে? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
তার প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না কেউ। ছুটতে শুরু করেছে। সাইকেলের দিকে। করুণ চোখে ওদের যাওয়া দেখলো মুসা। তারপর ঘুরলো। শেষ বিকেল। আরও মলিন হয়েছে ধূসর আলো। লুকানোর জায়গা খুঁজতে শুরু করলো সে। পরিত্যক্ত পার্কের একটা উঁচু বেড়ার ওপর চোখ পড়লো, কারনিভলের প্রবেশপথ থেকে বিশ গজমতো দূরে।
বেড়ার জায়গায় জায়গায় এখানে ফুটো, ফোকর। পুরনো, বিশাল নাগরদোলার ভারি স্তম্ভগুলোর মাথা বেড়া ছাড়িয়ে উঠে গেছে। ওখানে লুকানোই সব চেয়ে সুবিধেজনক মনে হলো মুসার। চট করে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। কেউ তাকিয়ে নেই তার দিকে, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আস্তে আস্তে বেড়ার কাছে সরে এলো সে।
কেউ দেখছে না তাকে, আরেকবার চেয়ে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বেড়ার একটা। ফোকরে মাথা ঢুকিয়ে দিলো সে। অন্যপাশে চলে এলো। নাগরদোলার স্তম্ভের মাঝের ফ্রেম বেয়ে উঠতে শুরু করলো। এমন একখানে এসে থামলো, যেখান থেকে কারনিভলের প্রবেশ পথ পরিষ্কার দেখা যায়।
মোটা একটা লোহার ডাণ্ডার ওপর পা ঝুলিয়ে বসলো সে। গা ছমছমে অনুভূতি। চারপাশের বিষণ্ণতা যেন হা করে গিলতে আসছে তাকে। ঠাণ্ডা বাতাসে বিচিত্র ক্যাচকোচ আওয়াজ করছে ভাঙা, পুরনো কাঠের কাঠামো, নীরব শূন্যতা সইতে না পেরে যেন গুঙিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে, সেই সঙ্গে মিলিত হচ্ছে জোর বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। মুসার মনে হলো, উঁচু ওই বেড়াটা ওপাশের জীবন্ত পৃথিবী থেকে আলাদা করে দিয়েছে তাকে।