নীরবে কাজ করে চলল তিন গোয়েন্দা। ঘোড়ার খুরের শব্দে চোখ তুলে তাকাল। ম্যাকআরথারের সীমানার ওদিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে জিনা। খোয়াড়ে ঢুকল, অ্যাপলুসাটাকে ওখানে রেখে চলে গেল বাড়ির ভেতরে।
খানিক পরে এঞ্জিনের শব্দ কানে এল ছেলেদের। গোলাবাড়ির দিকে চেয়ে বলে উঠল মুসা, খাইছে? কাণ্ড দেখো।
পিকআপের ড্রাইভিং সীটে দেখা যাচ্ছে জিনাকে। গিয়ার দেয়ার শব্দ হলে। এলোমেলো ভাবে দুলতে দুলতে পথ ধরে ছুটে এল গাড়িটা।
চেঁচিয়ে বলল মুসা, জিনা, পাগল হয়ে গেছ নাকি! করছ কি?
ট্রাকের নাক সোজা রাখতে পারছে না জিনা.। ছুটে এল ছেলেদের দিকে, শেষ মুহূর্তে ব্রেক প্যাডালে পা রেখে প্রায় দাঁড়িয়ে গেল। জোর কাশি দিয়ে থেমে গেল এঞ্জিন। পারছি, শোনা গেল জিনার আনন্দিত কণ্ঠ, চালাতে পারছি। খোলা জায়গায় ঠিকই পারব।
চালাতে হলে আরও বড় হওয়া লাগবে তোমার, রবিন বলল।
লাইসেন্স পেতে বড় হওয়া লাগবে, জিনা জবাব দিল। কিন্তু সীটে বসে প্যাডাল যখন ছুঁতে পারছি, চালাতেও পারব।
আবার এঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল, পারল না। হুঁ, গ্র্যাকটিস দরকার।
তোমার চাচা জানেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
নিশ্চই। চাচা বলে বড়রা যা করে, ছোটদেরও তা করতে পারা উচিত। আমার কোন কাজে চাচা বাধা দেয় না।
সেজন্যেই বুঝি চাচা আর ভিকি বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলে? ওরা থাকতে সাহস পাওনি?
জানালা দিয়ে মুখ বের করল জিনা, চোখ উজ্জ্বল। মুসার কথার জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলল, দুজনে বাজারে গেছে, ফিরতে দেরি হবে। ম্যাকআরথারও বাড়ি নেই, কুত্তাটাকে বেঁধে রেখে গেছে। চলো, এই সুযোগ।
খনিতে তো? একাই যাও, আমরা এর মাঝে নেই।
ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ভাবছে কিশোর। গতরাতে গুলির শব্দ কোথা থেকে এসেছিল, সে কথা।
ভীতুর ডিম, মুসার দিকে চেয়ে মুখ বাঁকাল জিনা। থাকো তোমরা, আমি চললাম। আবার চেষ্টা করল সে, এবার স্টার্ট নিল এঞ্জিন।
রাখো রাখো, হাত তুলল কিশোর, আমি যাব।
গুড, হাসল জিনা। ছুরিটা নিয়ে এসো। ম্যাকআরথার দেখে ফেললে তাড়াতাড়ি খেতে নেমে গাছ কাটার ভান করবে। কি, তোমরা দুজন যাবে না?
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, ভাবল কে জানে, কিন্তু আর আপত্তি না করে এসে উঠল গাড়িতে। রবিনও উঠল।
কাঁচা হাতে গিয়ার দিল জিনা। প্রচণ্ড প্রতিবাদ জানাল এঞ্জিন, ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল গাড়ি। এবড়োখেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটে চলল ম্যাকআরথারের সীমানার দিকে।
দারুণ একখান গাড়ি, উল্লাসে ফেটে পড়ছে জিনা। গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বাকা হচ্ছে, সোজা হচ্ছে, এদিকে কাত হচ্ছে, ওদিকে কাত হচ্ছে। এরই মাঝে এক ফাঁকে মুসার দিকে চেয়ে বলল, খুব সহজ, বুঝলে? কোন ব্যাপারই না, শুধু গিয়ারগুলো ঠিকমত ফেলতে পারলেই হলো…
তা তো দেখতেই পাচ্ছি, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল মুসা। গাড়ি উল্টে ঘাড় না মটকালেই বাঁচি এখন। আস্ত এক কৌটা বাতের মলম লাগবে আজ আমার।
বেশি ভয় পাও তুমি…আঁউউ। ক্যাঙারুর মত আচমকা এক লাফ দিল গাড়ি, আলের মত একটা জায়গায় হোঁচট খেয়ে। আপনা আপনি জিনার হাত থেকে স্টিয়ারিং ছুটে গেল, পা সরে এল ক্লাচ থেকে। জোরে আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থেমে গেল, এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে আগেই। যাক, জায়গামতই এনে রেখেছি, মুসার দিকে তাকাচ্ছে না সে। এখান থেকেই ম্যাকআরবারের সীমানা শুরু।
সামনে রুক্ষ, অসমতল ভোলা জায়গা, হঠাৎ করে গিয়ে শেষ হয়েছে যেন, পর্বতের গোড়ায়। এক ধারে কালো বেড়া, খনির কালো মুখ দেখা যাচ্ছে। বেড়ার ওপর দিয়ে খনির ভেতরটা দেখতে অসুবিধে হচ্ছে, তবু কয়েক ফুট পর্যন্ত নজর চলে। সুড়ঙ্গের মেঝেতে সাদা মিহি বালি, এখান থেকেও বোঝা যায়। খনির ডানে ম্যাকআরথারের নোংরা কেবিন।
আস্ত মেথর, নাক কোচকাল জিনা। পরিষ্কার করার সময় পায়নি হয়তো, বলল রবিন। কদ্দিন হলো এসেছে?
প্রায় এক মাস। এসেছে তো একটা ফকিরের মত, বিছানা, হাঁড়ি-কড়াই আর কয়েকটা বাসন-পেয়ালা, ব্যস। নতুন আর কিছু কিনেছে বলে মনে হয় না। একেবারে চামার।…ওই যে বিল্ডিংটা ওতে খনির কাজকর্ম হত। খনি থেকে আকরিক তুলে নিয়ে জমা করা হত ওখানে, তারপর রুপা আলাদা করা হত।
শেকলের শব্দ শোনা গেল, কেবিনের কোণ থেকে বেরিয়ে এল কুকুরটা। ছুটন্ত অবস্থায় যতখানি বিশাল মনে হয়েছিল সেদিন কিশোরের তত বড় নয়, তবে বড়। শিকারী-লাব্রাডর আর জার্মান ভেড়া-তাড়ানো কুকুরের শঙ্কর। আগন্তুকদের দেখে চাপা গর্জন করে উঠল।
চেনটা শক্ত কিছুঁতে বাঁধা তো? বিড়বিড় করল মুসা।
হ্যাঁ,মুসার ভয় দেখে হেসে ফেলল জিনা। তখন চেতিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখে গেছি। টানাটানি অনেক করেছে, ছুটতে পারেনি।
কখন করলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
এই তো খানিক আগে, কমেটকে নিয়ে এলাম না।
এত সাহস যে দেখালে, যদি ছুটে তে।
গেলে যেত। কমেন্টের সঙ্গে দৌড়ে পারত নাকি? লাথি খেলেও বাপের নাম ভুলে যেত। ভিকি খালা তো গুলি ছুঁড়ে ভুল করে, কমেটকে ডেকে এনে একটা লাথি খাওয়ানো দরকার ছিল। জিন্দেগীতে আর মুরগীর দিকে চোখ তুলে তাকাত না।
তুমি না কুকুর ভালবাস, জিনা? মুসা বলল, এটাকে দেখতে পারো না কেন? রাফিয়ানকে তো…