পুলের পরে একটা কাঁচা রাস্তায় নামলো গাড়ি, পেছনে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে চলল। মাইলখানেক দূরে পথের বাঁয়ে সবুজ খেত। আরও পরে একটা খোলা গেট দেখা গেল, তার ওপাশে কয়েকটা বাড়িঘর। একটা বাড়ি নতুন বঙ করা হয়েছে, বাকিগুলো পুরানো, দেখে মনে হয় না মানুষ থাকে।
গতি কমালেন মিস্টার উইলসন, হর্ন বাজালেন একজন লম্বা, হালকা-পাতলা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে, ছোট একটা বাড়ির সামনে বাগানে পানি দিচ্ছেন তিনি।
মিসেস ফিলটার, ছেলেদেরকে বলল জিনা।
হেসে হাত নাড়লেন মহিলা। পরনে ঢিলা পাজামা, গায়ে সাদা শার্ট, গলায় নীলকান্তমনি, খচিত রুপার একটা বেশ বড়সড় হার। ধূসর চুলে রুপালি ছোপ লেগেছে, বয়েস ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু হোস নেড়ে যেভাবে পানি দিচ্ছেন, ক্ষিপ্রতা দেখে মনে হয় না এত বয়েস।
এই শহরের সুদিন কালে এখানে জন্মেছিলেন মহিলা, জিনা বলল। খনির সুপারিনটেনডেন্টকে বিয়ে করেছিলেন। খনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চলে গিয়েছিলেন দুজনেই। স্বামীর মৃত্যুর পর ফিনিক্সে এক দোকানে কাজ নিলেন মহিলা, টাকাটুকা জমিয়ে, চাকরি ছেড়ে এখানে ফিরে এসেছেন বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাতে। যে বাড়িতে বৌ হয়ে ঢুকেছিলেন, বিক্রি করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেটাই কিনে নিয়েছেন আবার। আরও কিছু জায়গা কিনেছেন মহিলা, বোধহয় পুরানো দিনের
স্মৃতি ধরে রাখার জন্যেই ভুলেও কখনও ব্যবহার করেন না ওগুলো।
ম্যাকআরবারের সঙ্গে মহিলার যথেষ্ট মিল দেখা যাচ্ছে, বলল রবিন।
না না, জোর গলায় বলল জিনা, মহিলা খুব ভাল।
আসলে, এখানে যারা ফিরে আসে তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল থাকেই, বললেন উইলসন, টুইন লেকসকে একবার ভালবেসে ফেললে দুনিয়ার আর কোথাও গিয়ে শান্তি নেই, ফিরে আসার জন্যে খালি আনচান করে মন। শেষ বয়েস কাটানোর এত চমৎকার জায়গা কমই আছে। গেটের সামনে এনে গাড়ি থামালেন। হাত তুলে দেখালেন, পথটা গিয়ে শেষ হয়েছে পর্বতের উপত্যকায়। ওটা পশ্চিম। তার বাঁয়ে পোয়াটাক মাইল দূরে কালো রঙ করা কাঠের বেড়া। ওটাই খনিমূখ। আর ওই যে কেবিনটা, ওটাতে থাকে ম্যাকআরথার। পেছনে যে বিল্ডিংটা, ওটাও তার। আগে ওখানে খনির নানারকম কাজকর্ম হত।
গেটের ভেতরে গাড়ি ঢোকালেন তিনি। মাটির রাস্তা, তাতে চাকার গভীর খাজ। চলার সময় আপনাআপনি চাকা ঢুকে যায় খাজের মধ্যে, সরানো কঠিন। পথের দুধারে সারি সারি নবীন ক্রিস্টমাস গাছ। বেড়া দেয়া একটা পশু রাখার খোয়াড়ের পাশ কাটিয়ে এল গাড়ি, ভেতরে গোটা চারেক ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে, ওগুলোর মাঝে জিনার কমেটকে চিনতে পারল তিন গোয়েন্দা। আরও পরে, বায়ে সুন্দর একটা র্যাঞ্চ হাউস, ছোট ছোট গাছ ঘিরে রেখেছে। সীডার-লাল রঙের ওপর সাদা অলঙ্করণ, চার পাশের সবুজের মাঝে ছবির মত লাগছে বাড়িটাকে। পথের শেষ মাথায় ভাঙাচোরা পুরানো একটা গোলাবাড়ি, কতকাল আগে রঙ করা হয়েছিল এখন আর বোঝা যায় না।
র্যাঞ্চ-হাউসের সামনে এনে গাড়ি রাখলেন উইলসন, হাই তুললেন, আড়মোড়া ভাঙছেন। আউফ। বাড়ি এলাম।
গাড়ি থেকে নামল ছেলেরা, আশপাশ দেখছে। গোলাবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা পিকআপ ট্রাক, ধুলোয় মাখামাখি। বাড়ির একপাশে তারের বেড়া দেয়া খানিকটা জায়গা, একাংশ চোখে পড়ছে, ভেতরে কয়েকটা মুরগী।
গাড়ি থেকে নামলেন উইলসন। তাজা ডিম পছন্দ আমার, মুরগীর খোঁয়াড় দেখিয়ে বললেন। সকালে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙার মাঝে এক ধরনের আনন্দ আছে, খুব শান্তি। আমার মোরাটার ধারণা, রাত্রি তাড়ানোর দায়িত্বটা বুঝি তারই ওপর বর্তেছে, ভোর না হতেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে। আমার খুব ভাল লাগে।
মনিবের কথার জবাবেই যেন বাড়ির পেছন থেকে শোনা গেল তার কণ্ঠ, ডাক নয়, উত্তেজিত চিৎকার।
এক সেকেন্ড পরেই যেন একসঙ্গে খেপে গেল সব কটা মোরগ-মুরগী, বাচ্চাকাচ্চা সব। পরক্ষণে শটগানের বিকট শব্দ।
চেঁচিয়ে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মুসা, দুহাতে মাথা ঢাকল। গাড়ির আড়ালে মাথা নুইয়ে ফেলল কিশোর আর রবিন। মুরগীর খামারের ওদিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে একটা বিরাট ছায়া।
পলকের জন্যে কিশোরের চোখে পড়ল একসারি ঝকঝকে ধারাল দাঁত আর কালো দুটো চোখ। পরক্ষণেই ধাক্কা দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে গায়ের ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে গেল জানোয়ারটা, হারিয়ে গেল পশ্চিমে ক্রিস্টমাস খেতের ভেতরে।
৩
শান্তির রাজ্যে স্বাগতম। বেদম হাসিতে দুলছে জিনা।
বিকেলের শান্ত নীরবতা ধীরে ধীরে নেমে এল আবার র্যাঞ্চ হাউসে।
উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মিটমিট করল মুসা। খাইছিল! কি ওটা?
কিছু না, টিটকারির ভঙ্গিতে বলল জিনা, বিশিষ্ট ভদ্রলোক জনাব হ্যারি ম্যাকআরবারের শিকারী কুকুর, মুরগী চুরির তালে ছিল।
কিশোর উঠে দাঁড়াচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে বলল, বেড়ার নিচ দিয়ে সিধ কেটে ঢোকার চেষ্টা করে। কয়েকবারই করেছে এ-রকম। মুরগীগুলো চেচামেচি শুরু করে দেয়, শটগান নিয়ে ছুটে বেরোয় ভিকিখালা। আজও ফাকা গুলিই ছুঁড়েছে, কিন্তু এই অত্যাচার চলতে থাকলে কপালে দুঃখ আছে কুত্তাটার। ছররা দিয়ে পাছার চামড়া ঝাঝরা করে দেবে।
ভিকিখালা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
আমাদের কাজের লোক, জানালেন উইলসন।
গোলাবাড়ির ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল মোটাসোটা এবং মেকসিকান মহিলা, কালো চুল। সুতার পোশাক পরনে, গলা আর হাতার কাছটায় এমব্রয়ডারি করা উজ্জ্বল রঙের বড় বড় ফুল। হাতে একটা শটগান।