ওপরের দিকে গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। কিন্তু অবশেষে বাঁক নিল পথ। সাপের মত একেবেঁকে খানিক দূর নেমে গিয়ে সোজা হলো।
বোধহয় বাচলাম, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল বিংগো।
স্টিয়ারিঙে হাতের চাপ যদিও শিথিল করতে পারছে না। ঢিল পড়লেই নাক ঘুরিয়ে গাছের গায়ে গুতো মারার জন্যে রওনা দেয় গাড়ি।
চাঁদ ডুবে গেছে। আকাশে শুধু তারা মিটমিট করছে, ওপরেও ছায়াপথ, নিচেও ছায়াপথ বানিয়ে রেখেছে। যতই নামছে গাড়ি, দু-ধারে সরে যেন বেশি করে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে বন, পথ চওড়া হচ্ছে।
উপত্যকায় নামল গাড়ি। সামনে আড়াআড়ি চলে গেছে আরেকটা পাকা রাস্তা। তার ওপাশে বিস্তৃত মরুর খোলা শূন্যতা।
গাড়ি থামিয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকাল বিংগো। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে, বেড়েছে। ফোঁসফোসানি।
হেসে বলল হ্যারি, পুলিশ নেই। বলেছিলাম না, মেইন রোডে থাকবে ওরা। এদিকে আসব আমরা, কল্পনাও করেনি।
এখনও বলা যায় না, বিংগো খুশি হতে পারছে না। রোড ধরে যাবই না। সোজা চালাল সে। ঝাঁকুনি খেয়ে পাকা রাস্তায় উঠল ট্রাক, রাস্তা পেরিয়ে আবার ঝাঁকুনি খেয়ে নামল মরুভূমিতে।
মাথায় বাড়ি খেয়ে আঁউক! করে উঠল জিনা। মস্ত এক গর্তে পড়ে ক্যাঙারুর মত লাফ দিয়ে আবার উঠে পড়েছে গাড়ি। জিন্দেগীতে জায়গামত যাবে না এই ট্রাক।
চুপ! ধমক দিল বিংগো। অস্বস্তিতে ভুগছে। ঝাল ঝাড়ল আধপোড়া সিগারেটের ওপর, অ্যাশট্রেতে পিয়ে মারল ওটাকে। যেতেই হবে। মরুভূমি পেরোলে সামনে অন্য পথ পাবই। ওখানে পুলিশ থাকবে না।
শেষ তারাটাও মলিন হলো, মিলাল মহাশূন্যে।
ফিরে তাকাল মুসা, পেছনে পাহাড়ের চূড়ায় লালচে আভা। আঁধার কাটছে দ্রুত। খানিক পরেই উঁকি দেবে টকটকে লাল সূর্য। পাকা রাস্তা এখন অনেক পেছনে।
সামনে শিগগিরই আরেকটা পথ পাব, বিড়বিড় করে নিজেকে আশ্বাস দিল যেন বিংগো। যেটাতে…হুঁক…
চোরা গর্তে পড়ে কাত হয়ে গেছে ট্রাক। জোর হিসহিস শোনা গেল, ধোয়া বেরোতে শুরু করল রেডিয়েটর থেকে।
সব্বোনাশ! এঞ্জিন বন্ধ করে, ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে বালিতে লাফিয়ে গিয়ে পড়ল বিংগো। ঘুরে গিয়ে উঁকি দিল ট্রাকের নিচে। এঞ্জিনের সামনের অংশ থেকে বালিতে পড়ছে মরচে রঙের পানি, ময়লা করছে ধবধবে সাদা বালি।
কি হলো? হ্যারির গলার ভেতরটা সিরিশ দিয়ে ঘষেছে যেন কেউ।
রেডিয়েটর খতম, অচেনা লাগছে বিংগোর কণ্ঠস্বর। অ্যাক্সেল দুই টুকরো। গুঙিয়ে উঠল হ্যারি। সর্বনাশ!
জানালার কাছে এসে জিনার দিকে পিস্তল তাক করল বিংগো। নামো। মুসাকে বলল, এই, তুমিও।
হলো তো এখন? কালো হয়ে গেছে জিনার মুখ।
চুপ। নামো।
নামল দুজনে। হ্যারিও নামল। শূন্য চোখে তাকাল ছড়ানো মরুর দিকে। সামনে দেখিয়ে বলল, ওদিকে পাহাড় পেছনে রেখে সোজা হাঁটব। আগে-পরে পথ পেয়ে যাবই।
না, জেদ ধরল জিনা। এখানে হাঁটতেই থাকবে, হাঁটতেই থাকবে, পথ আর পাবে না। তারপর সূর্য উঠলে টের পাবে মজাটা। দেখতে দেখতে একশো ডিগ্রী ছাড়িয়ে যাবে গরম, কাবাব হয়ে যাবে। ট্রাকে বসে থাকাই ভাল।
ট্রাকে থাকলে মরব, বলল হ্যারি।
বাজে কথা রেখে হাঁটো তো, আবার ধমক দিল বিংগো।
না, বালিতে বসে পড়ল জিনা। গুলি করে মেরে ফেললেও আমি যাব না। রোদে কাবাব হওয়ার চেয়ে গুলি খেয়ে মরা অনেক আরামের। গরমে মগজ গলে নাক দিয়ে বেরিয়ে আসবে।
দ্বিধা করল মুসা। তারপর বসে পড়ল জিনার পাশে।
ভীষণ দৃষ্টিতে তাকাল বিংগো। পিস্তলের হাতলে চাপ বাড়ছে, সাদা হয়ে যাচ্ছে আঙুল।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি, লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে।
জিনা আর মুসার ওপর বার দুই নজর সরাল বিংগো, কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিস্তলটা ঢুকিয়ে রাখল পকেটে। ঘুরে রওনা হয়ে গেল সঙ্গীর পেছনে।
নীরবে চেয়ে আছে জিনা আর মুসা।
ছোট হতে হতে যেন ধোয়ার ভেতর মিলিয়ে গেল দুই ডাকাতের অবয়ব। দ্রুত চড়ছে সূর্য, গরম বাড়ছে। রাতের শিশিরে ভেজা বালি থেকে বাষ্প উঠতে শুরু করেছে ধোয়ার মত।
হতাশ হয়ে যদি ফিরে যায় ওরা? কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল মুসার কণ্ঠ থেকে। যদি খোঁজা বাদ দেয়? পিপাসার ছাতি ফেটে মরব।
১৮
জিনা আর মুসা যেখানে রয়েছে, তার থেকে অনেক ওপরে বসে কিশোর আর রবিন দেখল, পর্বতের চূড়া লাল হয়ে উঠছে ভোরের কাঁচা রোদে।
সুইচ টিপে সার্চ লাইট নিভিয়ে দিয়ে বড় করে হাই তুললেন শেরিফ। সারা রাত জেগে থেকে চোখ লাল।
নড়েচড়ে বসল বোরম্যান। সারারাত পাহাড়ের ওপরে আকাশে চক্কর দিয়েছে, আরেকবার দেয়ার জন্যে তৈরি হলো।
অবাক কাণ্ড! বলল সে। হাওয়া হয়ে গেল নাকি ওরা? কোনও জায়গা তো আর বাদ রাখিনি।
গেল কই? না ঘুমিয়ে আর দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে রবিনের মুখ। মেইন লোভ ধরে নামেনি, তাহলে পুলিশের চোখ এড়াতে পারত না। আরেকটা কপ্টার যে বেরিয়েছে, তারাও কোন খোঁজ পাচ্ছে না। বাতাসে তো আর মিলিয়ে যেতে পারে না।
পাহাড়ে জঙ্গলে কোথাও লুকিয়ে আছে, ক্লান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। অসংখ্য পোড়ো শহর আছে, ছাউনি আছে, তার মধ্যে ঢুকে বসে থাকলেও আকাশ থেকে দেখব না।
ঠিকই বলেছ, সায় দিলেন শেরিফ। দেখা যাবে না। কিন্তু আমি ভাবছি, মরুভূমিতে নেমে যায়নি তো? রোড ক্রস করে? সেটা করলে মরবে। পানিও নেই ওদের সঙ্গে, খাবারও নেই।