বড় বড় পাথরের চাঙড় কিভূত ছায়া সৃষ্টি করছে। ওপর থেকে আঁকাবাকা একটা ফিতের মত লাগছে হ্যামবোনের সড়কটাকে। সবুজ গাছপালার মাঝে এখন প্রায় সাদাই দেখাচ্ছে ওটা।
ট্রাকটা এখুনি ফেলে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করবে না, বোরম্যান বলল। এই পথেই অন্তত হ্যামবোন পর্যন্ত যাবে।
হঠাৎ মোড় নিল কপ্টার। তৈরি ছিল না, পাক দিয়ে উঠল কিশোরের পেটের ভেতর, এক ধরনের অদ্ভুত শূন্যতা।
টুইন লেকস টু হ্যামবোন সড়কের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখা হলো, কিন্তু ট্রাকটা পাওয়া গেল না। এত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে গেল? বিশ্বাস করতে পারছেন না শেরিফ। তা-ও আবার আলো না জেলে?
নড়ে উঠল রবিন।
তার দিকে তাকালেন শেরিফ, অভয় দিয়ে বললেন, ভেব না, থােকা। আমার অ্যাসিসটেন্ট জীপ নিয়ে আসছে। যাবে কোথায় ব্যাটারা?
হ্যামবোনে কপ্টার অনেক নিচুতে নামিয়ে আনল বোরম্যান। বাড়িঘরের প্রায় ছাত ছুঁয়ে উড়ে চলেছে।
ওটা কি? চেঁচিয়ে উঠলেন শেরিফ। একটা ট্রাক-খনির ছাউনিটার কাছে।
ঝুঁকে দেখে বলল কিশোর, ওটা মিসেস রোজি ফিলটারের। বিকেলেই দেখেছি আমরা, খালি। মহিলা নেই।
কি ঘটছে এসব?
আরও অনেক ব্যাপার আছে, পরে সব খুলে বলব। আগে জিনা আর মুসাকে খুঁজে বের করা দরকার।
হ্যামবোন পেরিয়ে গিয়ে থাকলে পশ্চিমের ঢালে কোথায় আছে, কোনও একটা সরু পথে। কিন্তু কোনটায় যে গেল, সেটা বোঝাই তো মুশকিল।
একটাই উপায় আছে, বলতে বলতেই কপ্টারের নাক পশ্চিমে ঘোরাল বোরম্যান। দ্রুত পেছনে পড়তে লাগল ভূতুড়ে শহর হ্যামবোন।
মাথার ওপরে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনছে জিনা আর মুসা। গাছের পাতার ওপর দিয়ে গিয়ে রাস্তায় নামল সার্চলাইটের আলো।
কিন্তু আলো আর ফিরে এল না ওখানে চলে যাচ্ছে হেলিকপ্টার। দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল এঞ্জিনের শব্দ।
খিকখিক করে হাসল বিংগো। এবার যাওয়া যায়। এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে আবার পথে নামিয়ে আনল ট্রাক। আলো না জ্বেলেই আবার এগিয়ে চলল হ্যামবোনের দিকে।
একবার বেরোতে পারলে এই হতচ্ছাড়া পথে আর আসছি না, ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস টানল সে। এসে আর লাভও নেই। নিশ্চয় এতক্ষণে জোরেশোরে খুঁজতে শুরু করেছে ম্যাকআরখার, আগে না পেয়ে থাকলে কিছু যে খুঁজতে গেছি আমরা, নিশ্চয় বুঝে ফেলেছে।
দশ লাখ ডলারের বোঝাটা কতবড়? জিজ্ঞেস করে বসল জিনা।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল বিংগো, ফিরে তাকাল। তোমাকে কে বলেছে?
চুপ করে রইল জিনা।
সিগারেট বের করে ধরাল বিংগো। হ্যারি, এ দুটোকে কোথাও ফেলে দেয়া দরকার। এমন কোথাও, যাতে তার বাড়ি ফিরতে না পারে।
কেশে উঠে হাত নেড়ে নাকের সামনে থেকে ধোয়া ত্যাভাল জিন। এত বাজে অভ্যাস, এই ধোয়া টানা, বলল সে। ফুসফুসের দফা রফা, গলাও শেষ, কথা বললে বঙের আওয়াজ বেরোয়। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলে, আমাদের কোথাও ফেলে যাবে? তাতে কি লাভ? ফিনিক্সে যে তোমরা ডাকাতি করেছ, তিন ডাকাত আর এক ডাকাতনী মিলে, এটা আরও লোকে জানে।
গুঙিয়ে উঠল হ্যারি। অন্য ছেলে দুটো? বোকার মত রেখে এলাম।
বোকা নয়, শুধরে দিল জিনা, বলো, গাধার মত। গর্দভচন্দ্র।
বন্দুক তুলে পেছন থেকে হুমকি দিল হ্যারি। চুপ হয়ে গেল জিনা।
হ্যামবোন থেকে উল্টো দিকের পথ ধরে নেমে চলল ওরা। লো গীয়ারে চালাচ্ছে বিংগো এক জায়গায় এসে ডানে আরেকটা শাখাপথ বেরিয়েছে, সরু পথ, বেজায় রুক্ষ।
উপচে পড়া অ্যাশট্রেতে সিগারেট টিপে নেভাল বিংগো। মূল সড়ক, যেটাতে রয়েছে সেটা দেখিয়ে জিনাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কোথায় গেছে?
জানি না।
পেছন থেকে ডেকে বলল হ্যারি, এটা দিয়ে যাওয়া উচিত না, মন সায় দিচ্ছে। নিচে হাজারখানেক পুলিশ নিশ্চয় ঘাপটি মেরে আছে। পাশের রাস্তায় নামো।
ঘোৎ-ঘোৎ করে কি বলল বিংগো, বোঝা গেল না। মোড় ঘুরে পাশের রাস্তায় গাড়ি নামাল। কাঁচা রাস্তা, অনেক কষ্টে যেন ওখানে জন্মানো থেকে নিজেদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছে দুপাশের গাছের জঙ্গল। গভীর দুটো খাজ, টায়ারের দাগ, তার ওপর মাঝেমাঝেই পাথর পড়ে আছে। ফলে আটকে যেতে চাইছে চাকা; জোর করে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলেই লাফিয়ে উঠছে ভীষণভাবে।
আরেকটা সিগারেট ধরাল বিংগো, কিন্তু টানতে পারল না। গাড়ি সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। গাল দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরল।
আগুনসহ তো ফেলেছ, বলল জিনা। দেখো, জঙ্গলে দাবানল লেগে যায় নাকি? তাহলে পুরো পুলিশ ফোর্স ছুটে আসবে তোমাদের নাকে লাগাম পরাতে।
তীক্ষ্ণ টিটকারি নীরবে হজম করল বিংগো, জবাব দেয়ার উপায় নেই, গাড়ি সামলাতে ব্যস্ত।
মুসা আর জিনার মনে হলো অনন্ত কাল ধরে চলেছে তারা ওই পাহাড়ী পথ ধরে। মাঝে মাঝে বনের ভেতর পরিত্যক্ত কেবিন চোখে পড়ছে, কি এক গোপন রহস্য লুকিয়ে রেখেছে যেন অন্ধকার ঘরগুলো। হ্যামবোনের চেয়ে ছোট আর বেশি ভূতুড়ে আরেকটা শহর পেরোলেন। সামনে এক জায়গায় একটা কথােট বসে ছিল রাস্তার ওপর, মহাগভীর, কিন্তু হেডলাইটের আলো চোখে পড়তেই ভীতু শেয়ালের মত কুঁই করে উঠে গিয়ে লুকালো পাশের অন্ধকার ঝোপে। মাথার ওপর কয়েক বার হেলিকপ্টারের আলো দেখা গেল। প্রতিবারেই জঙ্গলে ট্রাক ঢুকিয়ে ফেলল বিংগো। কপ্টার দূরে সরার আগে বেরোল না। ঘুমানোর চেষ্টা করল মুসা আর জিনা, কিন্তু যা ঝাঁকুনি ঝিমানোও সম্ভব নয়, ঘুম তো দূরে কথা।