নিজের ওপর রেগে গেল কিশোর, এত সহজে ধরা দিল বলে। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই, মেরিচাচীকে রাজী করাতে সে নিজেই চাপাচাপি করছে। তবে অখুশি হওয়ারও কোন কারণ নেই, রহস্যের পূজারী সে, রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে, তাছাড়া রয়েছে নতুন দেশ দেখার উন্মাদনা।
চাচী, হাসিতে ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার, মাকে আগে আপনি ফোন করে দিন, তারপর আমি গিয়ে বলব।
যাই লাইব্রেরিতে গিয়ে ছটি নিয়ে আসি, রবিন বলল। চাচী, আমার মাকেও বলবেন। বাবাও মনে হয় বাসায় আছে এখন। সাইকেলের দিকে দৌড় দিল সে।
সেদিকে চেয়ে হাসলেন চাচী।
হ্যাঁ, মিসেস পাশা, বললেন উইলসন, কিছু ভাববেন না। বেশি খাটাব না ছেলেদের
মোটেও ভাবি না আমি, হেসে বললেন মেরিচাচী, আদৌ খাটাতে পারেন কিনা দেখেন। কি ভাবে যে ফাঁকি দেবে, টেরই পাবেন না। আপনার কি মনে হয়, গাছ কাটার জন্যে ওদের এত উৎসাহ? মোটেও না। মস্ত কোন ঘাপলা আছে কোথাও, জিনার দিকে তাকালেন তিনি।
চট করে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল জিনা।
২
ওই যে, টুইন লেকস, ঘোষণা করলেন মিস্টার উইলসন।
বড় একটা এয়ার-কণ্ডিশনড স্টেশন ওয়াগনে করে অ্যারিজোনা মরুভূমি পাড়ি দিচ্ছে ওরা। দক্ষিণ-পশ্চিমে মাথা চাড়া দিচ্ছে নিউ মেকসিকোর পাহাড়শ্রেণী। পেছনের সীটে বসে উৎসুক হয়ে জানালা দিয়ে দেখছে ছেলেরা। পাকা, চওড়া সড়কের শেষ মাথায় রুক্ষ পর্বতের কোলে সবুজে ছাওয়া একটা মরুদ্যান যেন হঠাৎ করে গজিয়েছে। ধুলোয় ধূসর পথের ধারে কাঠের বাড়িঘর চোখে পড়ছে এখান থেকেই।
আরও এগোলো গাড়ি। মেইন রোডের ধারে পথের দিকে মুখ করে রয়েছে মুদ দোকান, ওষুধের দোকান, খবরের কাগজের অফিস, আর ছোট একটা লোহালক্কড়ের দোকান।
শহরের কেন্দ্রে দোতলা একটা পাকা বাড়ি, কোর্টহাউস! বাড়িটা ছাড়িয়ে একটু দূরে পেট্রল স্টেশন, তারও পরে টুইন লেকসের দমকল বাহিনীর অফিস।
আগুন! হাত তুলে দেখাল মুসা।
শহরের বাইরে এক জায়গায় ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে কালো হয়ে গেছে বিকেলের আকাশ।
ভয় নেই, ফিরে বলল জিনা, সামনে, চাচার সীটের পাশে বসেছে। করাত কলের চুলোর ধোয়া।
এককালে খনিই ছিল এখানকার গরম ব্যবসা, গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন মিস্টার উইলসন। এখন কাঠের কলই ভরসা। কাঠের ব্যবসাই টিকিয়ে রেখেছে শহরটাকে। অথচ, পয়তাল্লিশ বছর আগে কি জমজমাট শহরই না ছিল।
বেশি হট্টগোল আমার ভাল্লাগে না, বলল মুসা। মন টেকে না। শান্তই ভাল।
ক্ষণিকের জন্যে ফিরে তাকালেন মিস্টার উইলসন। শান্ত? জিনা, গপ্পো দুয়েকখান শোনাও তোমার বন্ধুকে। টুইন লেকস শান্ত, হাঁহ আমি বলতে চেয়েছি, আগের টাকার গরম আর নেই এখন শহরটার।
আমার গপ্পো এখন একটাই, সামনের দিকে চেয়ে থেমে গেল জিনা। হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। গাড়ি থামালেন মিস্টার উইলসন, জিনসের প্যান্ট আর লম্বা বুলিওয়ালা পশমী শার্ট পরা এক মিহলাকে রাস্তা পেরোতে দিলেন।
একটাই কথা,আবার বল জিনা, হ্যারি ম্যাকআরার একটা আস্ত ভণ্ড।
নাক দিয়ে হাসি আর গোঙানির মাঝামাঝি একটা বিচিত্র শব্দ করলেন মিস্টার উইলসন, ব্রেক চেপে রেখে ফিরলেন ছেলেদের দিকে। দেখো, জিনার কথায় মিস্টার ম্যাকআরবারের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে যেয়ো না। ও আমার পড়শী, আর পড়শীর সঙ্গে মুখ কালাকালি ভাল না। তাছাড়া সুখ্যাতি আছে তার। তার ওপর রয়েছে টাকা, প্রচুর টাকা। টুইন লেকস তার জন্মভূমি, এত বছর পরও তাই ফিরে এসেছে। আমাকে বলেছে, ছেলেবেলায় খনি শহরের অনেক রোমাঞ্চকর গল্প শুনেছে মা-বাবার মুখে, তখন থেকেই তার ইচ্ছে, সুযোগ হলেই সে ফিরে আসবে এখানে। খনিটা কিনেছে, তার কারণ, এককালে তার বাবা কাজ করত ওখানে। ওর কাজকর্ম আমার কাছে তো কই, অস্বাভাবিক ঠেকে না।
তাহলে খনির মুখ আবার খুলল কেন? তর্ক শুরু করল জিনা।
তাতে তোর মাথাব্যথা কিসের? বললেন চাচা। তার খনির মুখ সে খুলল না বন্ধ করল, তাতে কার কি? খোঁজ খবর নিয়েছি আমি অনেক, লোকটার কোন বদনাম শুনিনি।
ছেলেদের দিকে চেয়ে হাসলেন। কেন দেখতে পারে না জানো? জিনাকে শার্টের কলার চেপে ধরে বের করে দিয়েছিল ম্যাকআরথার, তারপর থেকেই যত রাগ। তবে অন্যায় কিছু করেনি সে, তাহলে আমিই তো গিয়ে ধরতাম। কয়েক বছর আগে ওই খনিতে পড়ে এক মহিলা মরেছে। দুর্ঘটনা আরও ঘটতে পারে। জিনাকে সেজন্যেই বের করে দিয়েছে সে।
হেসে ফেলল মুসা, কি শুনছি, জিনা? তোমাকে নাকি ঘাড় ধরে…
চুপ! রাগে কেঁপে উঠল জিনার গলা।
জিনাকে কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একজন লোক, দৃশ্যটা কল্পনা করে কিশোরও হাসি চাপতে পারছে না। বুঝতে পারছে, এজন্যেই চাচাকে ভজিয়েভাজিয়ে রকি বিচে নিয়ে গেছে জিনা, তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করে এনেছে। ম্যাকআরথারের ওপর প্রতিশোধ নিতে, এক কুলিয়ে উঠতে পারেনি…
ব্যাটা আস্ত ভণ্ড! চেঁচিয়ে বলল আবার জিনা।
একআধটু পাগলাটে হতে পারে, কিশোর বলল। কোটিপতিদের কেউ কেউ যেমন হয়।
তাতে দোষের কিছু আছে? বললেন মিস্টার উইলসন, ৱেক ছেড়ে গাড়ি চালু করে দিলেন আবার। জিনা, আমি চাই না ভদ্রলোককে তুমি বিরক্ত করো। তোমাদেরও বলে রাখলাম, কিশোর।
একটা কাঠের ব্রিজের ওপর উঠল গাড়ি, ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোচ্ছে। নিচে রু খাল, দুই মাথা গিয়ে পড়েছে দুটো ক্ষুদে দে, পুকুরই বলা চলে। ছেলেরা অনুমান করল জোড়া হদের জন্যেই নাম হয়েছে টুইন লেকস।