ভেরি গুড, মাস্টার পাশা, বিশীত কণ্ঠে বলল খাঁটি ইংরেজ শোফার।
অফিসেই রয়েছেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক। বিশাল টেবিলের ওপাশ থেকে স্বাগত জানালেন তিন গোয়েন্দাকে, এসো; ইয়াং ফ্রেণ্ডস। এবার কি সে?
খুলে বলল ছেলেরা।
মন দিয়ে শুনলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। পুতুলটা নিয়ে ভালমত দেখে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। পুরানো, অনেক পুরানো। অ্যামিউলেট। ইনডিয়ান কারিগরের কাজ, সন্দেহ নেই। ইনডিয়ান শিল্পের ওপর একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম করেছিলাম টেলিভিশনের জন্যে, অনেক কিছু জেনেছি তখন। অ্যামিউলেটটা দেখেই বোঝা যায়, চাম্যাশ ইনডিয়ানদের কাজ।
অ্যামিউলেট কি, স্যার? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মন্ত্রপুত পুতুল। গলায় ফাঁস লাগানো থাকে, এতে নাকি শয়তান কাছে ঘেঁষতে পারে না, মূর্তির মালিকের অশুভ কিছু ঘটে না। সেফ কুসংস্কার। চাম্যাশদের অনেকের কাছেই এ-ধরনের পুতুল আছে।
রকি বীচেও ইনডিয়ান ছিল?
ছিল, জবাব দিল রবিন। আগে রকি বীচে চাম্যাশ ইনডিয়ানরা ছিল উপকূলের ধারে, স্প্যানিশ জমিদারদের গোলামী করেছে অনেকে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, মাথা দোলালেন পরিচালক। এখন পক্ষীমানবের কথা বলো। লম্বা, কুঁজো, পাখির মত খুদে মাথা, ঝটকা দিয়ে দিয়ে নড়ছিল, অট্টহাসি হেসে উঠেছিল, না?
হ্যাঁ, স্যার।
তুমি আর মুসা ছায়াটার খুব কাছে ছিলে, একই সময়ে হাসি শুনেছ, অথচ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণনা করছ। তোমার কি মনে হয়, কিশোর?
বুঝতে পারছি না, স্যার।
আমিও না, স্বীকার করলেন পরিচালক। দেখি, মেসেজটা?
কাগজের টুকরোটা বের করে দিল কিশোর।
রক্তেই লেখা, ভাল করে দেখে বললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? খুব বেশি পুরানো নয় কাগজটা, বেশি দিন আগে রাখা হয়নি।
পড়তে পারছেন, স্যার? জিজ্ঞেস করল রবিন।
না। এরকম লেখা আর দেখিনি।
খাইছে! তাহলে? হতাশ কণ্ঠে বলল মুসা। কিশোর বলছিল, আপনি পড়তে পারবেনই।
এখন তাহলে কি করব, স্যার? রবিনও হতাশা ঢাকতে পারল না।
আমি পারিনি বলে যে অন্য কেউ পারবে না, তা-তো বলিনি, মিটিমিটি হাসছেন পরিচালক। আমার এক বন্ধু আছে। ইউনিভারসিটি অভ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রফেসর, প্রাচীন ভাষার বিশেষজ্ঞ। ফিচার ফিল্মটা করার সময় অনেক সাহায্য করেছে আমাকে। রকি বীচেই থাকে। আমার সেক্রেটারির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে যাও। কি হয়, জানিও আমাকে।
মিস্টার ক্রিস্টোফারকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। প্রফেসরের ঠিকানা লিখে নিল সেক্রেটারির কাছ থেকে। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে মাত্র কয়েক রক দূরে থাকেন প্রফেসর নরম্যান এইচ. হেনরি।
হ্যানসনকে রকি বীচে ফিরে যেতে বলল কিশোর।
প্রফেসর হেনরির ছোট্ট সাদা বাড়িটা রাস্তা থেকে দূরে। ঘন গাছপালায় ঘেরা। সীমানার চারপাশে সাদা খাটো খুঁটির বেড়া। হ্যানসনকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে, গেটের কাঠের পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকল কিশোর। পেছনে মুসা আর রবিন। ইট বিছানো পথ চলে গেছে গাড়িবারান্দায়। এগোল ওরা।
অর্ধেক পথ পেরিয়েছে, এই সময় পাশের ঘন ঝোপ থেকে বেরিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াল এক লোক।
এই, বলেই থেমে গেল রবিন।
বেঁটে, চওড়া কাঁধ লোকটার, গাঢ়-বাদামী পালিশ করা পাকা চামড়ার মত গায়ের রঙ। কালো, চঞ্চল চোখের তারা। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শক্ত ঝকঝকে দাঁত। মোটা খসখসে সূতী কাপড়ের শার্ট পরনে, একই কাপড়ের পাজামা, কোমরে কাপড়ের চওড়া বেল্ট কষে বেধেছে, মাথায় সাদা বড় হ্যাট। খালি পা।
হাতে বাঁকা, লম্বা ফলাওয়ালা ভয়াল এক ছুরি।
কালো চোখ জ্বলছে লোকটার। সামান্য কুঁজো হয়ে পা পা করে এগোচ্ছে, ছুরিটা সামনে বাড়ানো।
পাথর হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। আরেক পা এগিয়ে ভীষণ ভঙ্গিতে ছুরি নাড়ল লোকটা। বিচিত্র ভাষায় কি যেন বলে লাফিয়ে এসে পড়ল কাছে। থাবা দিয়ে কিশোরের হাত থেকে সোমার পুতুলটা ছিনিয়ে নিয়েই এক দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ঝোপে।
ঘটনার আকস্মিকতায় থ হয়ে গেছে ছেলেরা। নড়ার, এমন কি চিৎকার করার ক্ষমতাও যেন নেই।
সবার আগে সামলে নিল মুসা। নিয়ে গেল তো!
বিপদের তোয়াক্কা না করে লোকটার পিছে দৌড় দিল সে, ঝোপে গিয়ে ঢুকল হুড়মুড় করে। পেছনে ছুটল অন্য দুজন।
ঝোপঝাড় ভেঙে বাগানের এক ধারে বেরিয়ে এল ওরা। দেরি হয়ে গেছে। পুরানো রঙ-চটা একটা গাড়িতে উঠছে লোকটা। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে। আরেকজন। ছেলেরা বেড়া ডিঙানোর আগেই গর্জে উঠল পুরানো এঞ্জিন, চলতে শুরু করল গাড়ি।
যাহ, গেল অ্যামউলেট! চেঁচিয়ে বলল মুসা।
এই সময় পেছনে কড়া গলায় ধমকে উঠল কেউ।
৪
এই, কি হচ্ছে এখানে? হালকা-পাতলা একজন মানুষ, কাঁধ সামান্য কুঁজো। ধূসর চুল। পুরু কাচের চশমা। ছেলেদের দিকে চেয়ে আছেন।
আমাদের অ্যামিউলেট নিয়ে গেল! নালিশ করল যেন মুসা।
ছুরি দেখিয়ে, রবিন যোগ করল।
তোমাদের অ্যামিউলেট? চোখে বিস্ময় ফুটল মানুষটির। অ তোমাদেরকেই পাঠিয়েছে ক্রিস্টোফার। তিন গোয়েন্দা, না?
আপনিই প্রফেসর হেনরি? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
একটা প্রােমে নিয়ে এসেছ? প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়েই সারলেন প্রফেসর একটা অপরিচিত ভাষা বুঝতে পারছ না।
পোরেম নিয়ে এসেছিলাম, বিষণ্ণ কণ্ঠে রবিন বলল, এখন আর নেই। লোকট, নিয়ে গেছে।