কে লোকটা? অস্বস্তি বোধ করছেন মিস্টার মিলফোর্ড। ইয়ান ফ্লেচার তার বন্ধু, অনেক দিন থেকে চেনেন। সহজে রাগেন না চীফ, রেগেছেন যখন, ব্যাপার গুরুতর।
চোর, ভণ্ড, ওই যে কিশোর যা যা বলেছে, আঁকাবাকা গিরিপথের দিকে চেয়ে বললেন চীফ। দিনের আলো শেষ। সিডনি-পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। ডাংম্যানের নামে ওয়ারেন্ট আছে ওখানে। সাংঘাতিক এক ঠগ, ধোকাবাজ, প্রতারক, চোর-উঁচু উঁচু বাড়িতে দড়ি কিংবা পানির পাইপ বেয়ে উঠে চুরি করেছে। মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে টাকা আদায় করেছে। এমন কোন কুকর্ম নেই, যা সে করেনি। একেক জায়গায় গিয়ে একেক সংগঠনের দোহাই দিয়ে মানুষকে ঠকিয়েছে। মেকসিকোতেও পুলিশ খুঁজছে তাকে। এমন কি সহজ সরল ইনডিয়ানদেরকেও ফাঁকি দিয়েছে সে।
মেকসিকো? বলল কিশোর। কবের ঘটনা?
একবার তো যায়নি, কয়েকবার। তবে শেষ গিয়েছিল নাকি বছরখানেক আগে। অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের ধারণা, তারপর থেকেই আছে ক্যালিফোর্নিয়ায়।
তাহলে বছরখানেক আগেই জেনেছে চাম্যাশ হোর্ড আর মিস পেদ্রোর কথা।
মনে হয়। মহিলার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পড়েছে হয়তো পত্রিকায়, বললেন চীফ। তখনই ঠিক করেছে, ইংল্যাণ্ডে গিয়ে টনির সঙ্গে দেখা করবে।
পাহাড়ী পথ ধরে উঠে চলেছে রোলস-রয়েস। অনেক পেছনে রয়েছে পুলিশের হ্যানসন গাড়ি। কালো বিশাল গেটটা দেখা গেল, খোলা। গতি না কমিয়েই মোড় নিয়ে ঢুকে পড়ল হ্যানসন। শক্তিশালী এঞ্জিনের কোনরকম বিকার নেই, প্রতিবাদ জানাল শুধু মোটা টায়ার।
স্প্যানিশ-স্টাইল বিরাট বাড়ির সামনে এনে গাড়ি রাখল হ্যানসন। একটা ঘরেও আলো নেই, নির্জন মনে হচ্ছে। প্রাণের সাড়া নেই কোথাও।
রোলস-রয়েস থেকে নামল সবাই।
কেউ নেই নাকি? নিচু গলায় বললেন চীফ।
তাই তো মনে হয়, কিশোর বলল।
ঢুকে দেখা দরকার, বললেন মিস্টার মিলফোর্ড। হয়তো হাত-পা বেঁধে অন্ধকারে ফেলে রেখেছে মুসা আর রবিনকে।
পুলিশের গাড়িটাও এসেছে, থামল বাড়ি থেকে কিছু দূরে। নিঃশব্দে নেমে এল চারজন পুলিশ। ইশারায় ওদেরকে ছড়িয়ে পড়তে বলে কিশোর আর মিস্টার মিলফোর্ডকে নিয়ে সদর দরজার দিকে এগোলেন ফ্লেচার। তাদের পেছনেই রইল হ্যানসন।
নিচতলার প্রতিটি ঘর খুঁজে দেখা হলো। কেউ নেই।
জোরে জোরে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। সবাইকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে ডাংম্যান? চাম্যাশ হোর্ড নিয়ে পালানোর সময় মুক্তিপণ হিসেবে কাজে লাগানোর জন্যে?
কান খাড়া করল সবাই।
অন্ধকারে মৃদু থ্যাপ থ্যাপ শব্দ শোনা গেল।
ওপরে, বললেন চীফ। বাড়ির পেছন সাইডে।
পিস্তল বের করে হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন ফ্লেচার। পেছনে অন্যেরা। সাবধানে দোতলায় উঠে এল সবাই। করিডর ধরে এগিয়ে চলল পেছনে, যেদিক থেকে শব্দ এসেছে।
আবার শোনা গেল শব্দটা।
ওখানে, টর্চের আলোয় একটা দরজা দেখিয়ে বললেন মিস্টার মিলফোর্ড।
দরজায় তালা লাগানো। সবাইকে পাশে সরতে বলে খানিকটা পিছিয়ে এলেন ফ্লেচার। ছুটে গিয়ে কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা লাগালেন দরজায়। ভারি শরীরের প্রচণ্ড আঘাত সইতে পারল না পুরানো পাল্লা, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল।
উদ্যত পিস্তল হাতে ঢুকলেন চীফ।
ওই যে, দরজার কাছ থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার মিলফোর্ড।
ঘরের কোণে চিত হয়ে আছে যেন একটা মিশরীয় মমি—সারা শরীর দড়ি দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে বাঁধা হয়েছে। টনি। মুখেও কাপড় গোঁজা, চেঁচানোর উপায়, নেই। পায়ের নিচের দিক কোনমতে নড়াতে পারছে, সে-ই লাথি মেরেছে দেয়ালে। মুখের কাপড় খুলে ফেলতেই চেঁচিয়ে উঠল টনি, দাদী, ওই যে, ওখানে!
একটা চেয়ারে বসিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে মহিলাকে, মুখে কাপড়। তার বাঁধন খুলে দিল হ্যানসন।
আমি…আমি…কি হয়েছে? ঘোরের মধ্যে রয়েছেন যেন মিস পেদ্রো ও, মনে হয়েছে। ডাংম্যান। ট্রেতে করে বিকেলের চা নিয়ে এসেছিল, খেয়েছি। তারপর আর মনে নেই। হুঁশ ফিরলে দেখলাম এই অবস্থা। ঈশ্বর, এত ভয় জীবনে পাইনি! টনি, আরে, মেঝেতে কেন?
লাফিয়ে চেয়ার ছাড়তে গিয়ে টলে উঠলেন মহিলা। ধপ করে বসে পড়ে জিরিয়ে নিলেন এক মুহূর্ত। তারপর উঠে এসে বসলেন টনির পাশে। মুখে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তার দিকে চেয়ে হাসল টনি।
দড়ির বাঁধন কেটে দেয়া হলো। উঠে বসল টনি, বিকৃত করে ফেলেছে মুখ।
কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
দাদী ডাকলে পরে তোমাদেরকে লাইব্রেরিতে রেখে গিয়েছিলাম না? ফিরে এসে দেখি, তুমিও নেই, ডাংম্যানও না। শেষ বিকেলে ফিরে এল আবার। বলল, পুতুলটার ব্যাপারে জরুরী খবর আছে, দোতলায় গিয়ে বলবে। একটুও সন্দেহ না করে গেলাম। কি দিয়ে জানি বাড়ি মারল মাথার পেছনে। হুঁশ ফিরলে দেখলাম, মমি বানিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে বানিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে।
হুঁ, ডাংম্যানের পুরো পরিকল্পনাই পরিষ্কার হয়ে আসছে কিশোরের কাছে। ও আমাদেরকে বলেছে, তোমাকে খুঁজতে গেছে, ইয়ার্ডে নাকি তোমার গাড়িও দেখেছে, তারপর নাকি হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গেছ।
সব শয়তানী, বললেন চীফ। আসলে অনেক আগেই গিয়ে নিজের বাড়িতে বসে ছিল, রবিন আর মুসাকে ধরে আটকেছে। ওরা ওখানে আছে, কিশোরই জানিয়েছিল ব্যাটাকে।
প্লীজ, গুঙিয়ে উঠল কিশোর, আর লজ্জা দেবেন না। সব আমার দোষ, আমিই সব কথা বলেছি তাকে, হুঁশিয়ার করে দিয়েছি।