জোরে আরেকবার হেসে উঠে বেরিয়ে গেল ডাংম্যান।
বাইরে থেকে তালা লাগানোর ক্লিক শব্দ শোনা গেল।
পিছমোড়া করে হাত বাধা হয়েছে, খোলার চেষ্টা করল মুসা। খানিকক্ষণ টানাটানি করে ব্যর্থ হয়ে বলল, রবিন, আমার পিঠে পিঠ ঠেকাতে পারবে? গড়িয়ে চলে এসো তো।
দুজনেই রুক্ষ মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাছাকাছি হলো, পিঠে পিঠ ঠেকাতে পারল।
রবিনের কজির বাঁধন খোলার চেষ্টা শুরু করল মুসা। দরদর করে ঘাম ঝরল কপাল থেকে, দাঁতে দাতে চাপল সে। মনে হলো, যুগ যুগ পেরিয়ে গেছে, আঙুল ব্যথা হয়ে গেল, কিন্তু কিছুই করতে পারল না। ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
নাগালই পাই না, হাঁপাচ্ছে সে।
নাগাল পাওয়ার জন্যে কি আর বেঁধেছে, রবিন বলল।
ছুরিটাও নিয়ে গেছে হারামজাদা। দাতে কামড়ে ধরে…
দাঁত! শুয়ে পড়ো তো। কাত হয়ে।
রবিন শুয়ে দুই মোচড় দিয়ে সরে এল খানিকটা, মুখ নামিয়ে আনল মুসার হাতের কাছে। কজির দড়ি বেশ ভালমতই নাগাল পেল দাঁত দিয়ে। গিঁট কামড়াতে লাগল। লালা লেগে সামান্য নরম হলো দড়ি, প্রথম গিটটা কামড়ে ধরে টানাটানি করতে লাগল, কাঁচা মাংস কামড়ে ধরে কুকুর যেভাবে দু-পাশে মুখ-মাথা নেড়ে টেনে ছেড়ার চেষ্টা করে, সেভাবে।
কিছুক্ষণ টানাটানি করে থামল সে, জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করল।
তিনবারের মাথায় চিল হতে লাগল গিঁট।
চেঁচিয়ে উঠল মুসা, হচ্ছে! টের পাচ্ছি। আরও জোরে।
প্রথম গিটটা খুলে গেল। দ্বিতীয়টা খোলা আরও সহজ হলো।
বাঁধন মুক্ত হয়ে উঠে বসল মুসা, খুলে ফেলল পায়ের বাঁধন। এরপর রবিনের বাঁধন খোলাটা কোন ব্যাপারই না।
ডলাডলি করে বাধনের জায়গাগুলোতে রক্ত চলাচল সহজ করে নিল দুজনে। তারপর উঠে এসে দাঁড়াল জানালার কাছে। মুসা সামনের জানালায়, রবিন পেছনের।
মুসা বলল, গার্ডটাকে দেখতে পাচ্ছি। অন্ধকারেও ওর চোখ এড়িয়ে যেতে পারব না, এমন জায়গায় রয়েছে।
সব চেয়ে উঁচু চূড়াটার ওপাশে নেমে গেছে সূর্য। এপাশে আলো কমছে। রাত নামল বেশ তাড়াতাড়ি।
এদিক দিয়েও সম্ভব না, রবিন বলল। কয়েক ফুট পরেই খাদ। নাহ, যাওয়ার আশা বাদ।
ঘরের মাঝে রাখা টেবিলের কাছে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা।
টেবিলে রাখা লণ্ঠনের কাচে হাত বোলাতে বোলাতে বলল মুসা, কোথায় আছি অনুমান করতে পারছি। পশ্চিমে গিরিপথটা দেখা যায়। পর্বতের মধ্যে কোথাও রয়েছি আমরা, মিস পেদ্রোর বাড়ি থেকে মাইল পাচেক দূরে।
সঙ্কেত পাঠালে কেমন হয়, লণ্ঠনটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। পাঁচ-ছয় মাইল দূর থেকে দেখা যাবে রাতের বেলা।
প্রথমে কিছু বুঝল না মুসা। কিন্তু রবিনকে লণ্ঠনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে-ও তাকাল। ঠিক বলেছ। কিন্তু লণ্ঠন জ্বালাতে দেশলাই লাগবে।
লণ্ঠন যখন আছে, নিশ্চয় দেলাইও আছে, টেবিলের ড্রয়ার টান দিয়ে খুলল রবিন। এই যে আছে, বললাম না।
দুজনেরই মুখ উজ্জ্বল হলো। মোর্স কোড জানা আছে, রাতে এস ও এস পাঠাতে পারবে। কারও চোখে পড়ার সম্ভাবনা অবশ্য খুবই ক্ষীণ, তবু বলা তো যায় না। যদি পড়ে গেল?
পেছনের জানালার দিকে চেয়েই চমকে উঠল মুসা।
কি হলো? বলতে বলতেই ফিরল রবিন, দেখে স্থির হয়ে গেল সে-ও।
জানালার বাইরে একটা মুখ। বাদামী চামড়া।
পাল্লা খুলে ফেলে একে একে ভেতরে ঢুকল দুজন লোক। পরনে বিচিত্র সাদা পোশাক। হাতে লম্বা, বাঁকা ফলাওয়ালা ছুরি।
১৭
হুড়মুড় করে অফিসে ঢুকল কিশোর আর হ্যানসন।
ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন ইয়ান ফ্লেচার। দুজনকে ওভাবে ঢুকতে দেখে ভুরু কোঁচকালেন।
ডাংম্যান একটা ভণ্ড, স্যার! কণ্ঠস্বর সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছে কিশোরের। হোর্ভ চুরির তালে আছে ব্যাটা। তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে দেখলাম ওকে। নিশ্চই পেদ্রোজ এস্টেটে গেছে। আমি শিওর, মুসা আর রবিন ওখানেই আছে। স্যাণ্ডউইচের মোড়কটা ঠেলে দিল সে।
কাগজটা দেখলেন চীফ, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকলেন। হুঁ, খায় আমিষ, করে ভেজিট্যারিয়ান লীগ। মিলে যাচ্ছে।
কী?
আমি যা জেনেছি, কিশোরের কৌতূহল দেখে মিটিমিটি হাসছেন চীফ। দুনিয়ায় তোমরাই একমাত্র ডিটেকটিভ নও। হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ান পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। টনি পেদ্রোর ব্যাপারে ওরা কিছু জানে না, তবে ফগ ডাংম্যানের নাম অবশ্যই জানে।
কি জেনেছেন, স্যার?
উঠে দাঁড়ালেন চীফ। চলো, যেতে যেতে বলব। দেরি করা ঠিক না। বাদামী চোর দুটোকে পাইনি, কিন্তু আমার ধারণা, ডাংম্যানকে ধরতে পারলেই ওদেরও পেয়ে যাব। মিস্টার মিলফোর্ডকে ফোন করে দিয়েছি, পথে তুলে নেব। মুসার বাবাকে পাইনি, বেরিয়ে গেছে।
যাচ্ছি কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।
পেদ্রোজ এস্টেট। তোমার ধারণা বোধহয় ঠিক। ওখানেই পাওয়া যাবে শয়তানটাকে।
রোলস-রয়েসটা নিয়ে যাই, প্রস্তাব দিল কিশোর। ডাংম্যান ওটা চেনে না। পুলিশের গাড়ি দেখলেই পালাবে।
মন্দ বলনি। ঠিক আছে, আমি ওতে চড়েই যাব। আমার লোককে বলি, পুলিশ-কার নিয়ে পিছে আসুক।
চারজন পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রোলস-রয়েসে উঠলেন চীফ। কিশোর আগেই উঠেছে। গাড়ি ছেড়ে দিল হ্যানসন। রবিনদের বাড়ি থেকে তার বাবাকে তুলে নেয়া হলো।
উঠেই জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার মিলফোর্ড, ওদের খোঁজ পেয়েছেন, চীফ?
না, তবে পাবো।
ব্যাপার কি?
জানালেন ফ্লেচার। শেষে বললেন, ভাল কাজ দেখিয়েছে ছেলেরা। ওদের নিয়ে গর্ব করা উচিত আপনাদের, এমন ছেলের বাপ হয়েছেন। ওরা না থাকলে সাংঘাতিক বিপদে পড়ত টনি আর তার দাদী। আমরা জানতে জানতে দেরি হয়ে যেত। সব্বাইকে বোকা বানিয়েছে ডাংম্যানের বাচ্চা! পুলিশী মেজাজ ঠাণ্ডা রাখলেন জোর করে।