জঞ্জালের ভেতর দিয়ে কয়েকটা গোপন পথ বানিয়ে নিয়েছে তিন কিশোর, হেডকোয়ার্টারে ঢোকার পথ। ভাঙা ট্রেলারটাকে ঠিকঠাক করে নিয়েছে ওরা, ভেতরটা আর বোঝাই যায় না, বাতিল হয়ে পড়ে ছিল। চেয়ার-টেবিল আছে, টেলিফোন, টেপরেকর্ডার আর নানা রকম আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, ছোট একটা ল্যাবরেটরি, এমনকি খুদে ডার্করুমও রয়েছে ছবি প্রসেস করার জন্যে।
নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর; বলল, তাহলে, তোমাদের ধারণা, সাহায্যের জন্যে যে চেঁচিয়েছে সে-ই পুতুলটা ছুঁড়ে দিয়েছে? কিন্তু ধারণা দিয়ে তো কাজ হবে না, প্রমাণ চাই।
কি বলছ, কিশোর? প্রতিবাদ করল মুসা। চিৎকার শুনে বীরের মত এগিয়ে গেলাম সাহায্য করতে। অন্ধকারে পুতুল কুড়িয়ে নিলাম। ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে ভূত দেখলাম, হাসি শুনলাম, তা-ও পালালাম না। আর কি করতে পারতাম?
বস্ বস্ করল, বলল রবিন। ডাকাতের দল না-তো?
তাহলে ওই ভূতুড়ে ছায়াটা কি? পাখির মত মাথা, ঠোঁটের মত নাক, কুঁজো। আর কি হাসি। ভূতের বাপ ওটা, ডাকাত না।
অযৌক্তিক কথা বলে লাভ নেই, কিশোর বলল। হাসিটা কেমন?
তীক্ষ্ণ, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা। বাচ্চা ছেলের চিৎকারের মত।
না, মেয়েমানুষের, শুধরে দিল রবিন।
না, মেয়েমানুষ না। খেপার।
বদ্ধ উন্মাদের। পিলে চমকে দেয়।
বাজে হাসি, খুবই বাজে।
কেমন যেন বিষণ্ণ। বুড়ো মানুষের হাসির মত লাগে।
থামো, থামো, হাত তুলল কিশোর। হাসিটা একই সঙ্গে দুজনে শুনেছ?
নিশ্চই, জোর গলায় বলল মুসা। তবে একই হাসি কিনা বলতে পারব না।
আমি শুনতে পারলে ভাল হত, কেমন হাসি বুঝতে পারতাম। তবে সাহায্যের জন্যে যে চেঁচিয়েছে,এ তে তো কোন দ্বিমত নেই, নাকি?
না, একসঙ্গে বলল দুই সহকারী-গোয়েন্দা।
গভীর ভাবনা থেকে ডুব দিয়ে উঠল কিশোর। তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, জায়গাটা পেদ্রোজ এস্টেট।
আঙুল মটকাল রবিন। নিশ্চই। বুড়ো পেদ্রোর জমিদারি। পাঁচ হাজার একরের বেশি।
হ্যাঁ, বেশির ভাগই বন আর পাহাড়। ফসলের জমি তেমন নেই। শুনেছি, অনেক আগে বুড়োর নাকি গরুর পাল ছিল, গরু পুষত।
এখন নেই? মুসা জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল রবিন। না, লাইব্রেরিতে রেফারেন্স বইপত্র ঘেঁটেছিলাম একদিন। স্পেন থেকে এসেছিল বুড়োর দাদা, খামার করেছিল ওখানে। বুড়ো পেদ্রোর আমলেই গরু শেষ হয়ে যায়। তার একমাত্র মেয়ে মিস ভেরা পেদ্রোর জন্যে কিছু রেখে যেতে পারেননি। মিস ভেরাও বুড়ো হয়েছেন, খুব সাধারণ ভাবে থাকেন। ল্যাণ্ড-পুয়ার বলে একটা কথা আছে না, তাই। এত জায়গা, অথচ কাজে লাগাতে পারছেন না। টাকা নেই, লোকজন রাখতে পারেন না। এক চাকরানী আর একজন মালী, ব্যস। মহিলা নাকি একা থাকতে পছন্দ করেন, কেউ কখনও দেখা করতে যায় না তাঁর সঙ্গে।
বইয়ের পোকা রবিন, তিন গোয়েন্দার সমস্ত কেসের রেকর্ড রাখার দায়িত্ব তার ওপর, ফালতু কথা বলে না। সে যা বলছে, জেনেশুনেই বলছে।
গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। হুঁ। আচ্ছা, পেদ্রোজ এস্টেটে কি করছিল দুজনে? মূর্তিটাই বা ছুঁড়ে ফেলল কে?
দুজন নয়, একজন, শুধরে দিল মুসা। আরেকটা তো ভূত। ভূতের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এক ডাকাত।
কি ডাকাতি করতে যাবে ওখানে? মনে করিয়ে দিল রবিন, মিস ভেরা পেদ্রোর টাকা নেই।
পুতুলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে কিশোর। আশা করছে যেন, এখুনি কথা বলে উঠবে, প্রশ্নের জবাব দেবে। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল তার হাত।
কি হলো? জিজ্ঞেস করল রবিন।
পুতুলের নিচের দিকে এক জায়গায় নখ দিয়ে খুঁটছে কিশোর। ছোট্ট একটা দরজা খুলে মেঝেতে পড়ল কি যেন।
গোপন খুপরি! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
কাত হয়ে কুড়িয়ে নিল কিশোর, এক টুকরো কাগজ। ভাঁজ খুলে টেবিলে বিছিয়ে হাত দিয়ে ডলে সমান করল। দেখার জন্যে ঝুঁকে এল অন্য দুজন।
মেসেজ? বলল রবিন।
বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়ল গোয়েন্দা-প্রধান। লেখাই মনে হচ্ছে। কি ভাষা কে জানে।
ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে মুসা আর রবিন, ওরাও কিছু বুঝতে পারছে না।
এ-ভাষা আর কখনও দেখিনি, বলল কিশোর।
নীরবে খানিকক্ষণ কাগজটার দিকে চেয়ে রইল ওরা।
শোশ-শোনো, তোতলাতে শুরু করল রবিন। লে-লেখার…মানে, কালি দিয়ে লেখা হয়নি…রক্ত।
আলোর কাছে সরিয়ে নিয়ে আরও ভালমত লেখাটা দেখল কিশোর।
অস্বস্তিতে মাথা চুলকাচ্ছে মুসা।
ঠিকই বলছে, রবিন, একমত হলো কিশোর। রক্তেই লেখা। হাতের কাছে কালি-টালি কিছু ছিল না লেখকের।
হয়তো কোন বন্দি, রবিন অনুমান করল।
কিংবা দল-ছুট কেউ, মুসা বলল। ডাকাতের দল থেকে বেরিয়ে…
অনেক কিছুই হতে পারে, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তবে বোঝা যাচ্ছে, তিন গোয়েন্দার উপযুক্ত রহস্য, আরেকটা কেস। এখন প্রথম কাজ, মেসেজের পাঠোদ্ধার করা।
কে করবে?
একজনের কথাই মনে আসছে যিনি সাহায্য করতে পারবেন।
মিস্টার ক্রিস্টোফার?
হ্যাঁ। রাত অনেক হয়েছে, আজ বিরক্ত করা ঠিক হবে না। কাল সকালে ফোন করব।
৩
পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই স্যালভিজ ইয়ার্ডে ছুটে এল মুসা আর রবিন। রেন্টআ-রাইড অটো কোম্পানিতে ফোন করেছিল কিশোর, রাজকীয় রোলস-রয়েস নিয়ে হাজির হয়েছে হ্যানসন। পুরানো মডেলের কুচকুচে কালো বিশাল গাড়িটার জায়গায় জায়গায় সোনালি অলঙ্করণ, খুব সুন্দর।
আগে হলিউড যাব, হ্যানসন, বলল কিশোর, মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে।