কাঁধ ধরে ছুটতে শুরু করল রবিন। পেছনে কিশোর।
পাহাড়ের চূড়া ঘিরে রেখেছে কাঁধ। খানিকটা এগোতেই লোকগুলো আড়ালে পড়ে গেল। আরও পঞ্চাশ গজমত পেরিয়ে উল্টো দিকে মোড় নিল ওরা। নেমে যাওয়া পাহাড়ের ঢালে এখানে ওকের জঙ্গল শুরু হয়েছে, ঝোপও খুব ঘন।
যাচ্ছি কোথায়? হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর।
এখানেই।
আচমকা শুরু হয়েছে সবুজ জঙ্গল, যেন একটা সবুজ দেয়াল। তাতে এসে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ল রবিন, ঢুকে গেল বনে।
পেছনে ছুটছে কিশোর। হঠাৎ মাটি সরে গেল পায়ের তলা থেকে, মহাশূন্যে ঝাপ দিয়েছে যেন।
ময়দার বস্তার মত এসে ধাপ্পাস করে পড়ল সরু একটা গিরিখাতের তলায়। চারপাশে ঘন গাছের জঙ্গল। আগের রাতের ছড়ে যাওয়া হাঁটুতে নতুন করে চোট লাগল, ডলতে ডলতে উঠে বসল সে। তাকাল মাতালের মত।
আগেই বলতে পারতে, খসখসে কণ্ঠ, গলার ভেতরটা সিরিশ দিয়ে ঘষা হয়েছে যেন কিশোরের।
সময় পেলাম কই? পাশ থেকে বলল রবিন। তোমার মতই আমিও তো পড়েছি। একটা সাপকে লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলাম। যাক, ব্যাটারা আর খুঁজে পাবে না।
কি জানি, নিশ্চিন্ত হতে পারছে না কিশোর।
শশশ, ঠোঁটে আঙুল রাখল রবিন।
হামাগুড়ি দিয়ে খাদের কিনারে সরে এল দুজনে। ঝোপে ঢুকল।
আস্তে করে ঝোপের ডালপাতা সরিয়ে ওপরে উঁকি দিল রবিন।
বড় জোর পঞ্চাশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে লোকদুটো। কথা বলছে, একেক দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে, উত্তেজিত।
একেবারে শুয়ে পড়ল কিশোর। বুঝে গেছে, আমরা ধারে-কাছেই আছি।
কি করব এখন?
চুপ করে থাকব। আর কি করা?
চুপ করে শুয়ে রইল দুজনে, কান খাড়া। লোকগুলোর কথা আর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনিশ্চিতভাবে হাঁটাহাঁটি করছে ওরা, বোধহয় ঝোপের ভেতরে খুঁজছে। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কথা, কিন্তু এক বর্ণও বুঝতে পারছে না ছেলেরা।
ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর, দেখে ফেলবেই, লুকিয়ে বাচতে পারব না।
না-ও দেখতে পারে। গিরিখাতটা বাইরে থেকে দেখা যায় না।
তাহলে আমাদের মতই পা ফসকে ভেতরে পড়বে। বেরোনোর পথ আছে? ওদের চোখ এড়িয়ে?
এক মুহূর্ত ভাবল রবিন। বায়ে গভীর আরেকটা খাদ আছে, গথিক-বাড়িটার পেছনে যে আরেকটা পথ আছে, তার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে পঞ্চাশ ফুট খোলা জায়গা পেরোতে পারলেই খাদটায় গিয়ে নামতে পারব।
পঞ্চাশ ফুট, না? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। দু-চোখের কোণে খাজগুলো গভীর হয়েছে। তাহলে ওদের নজর এড়ানোর অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। এমন কিছু, যাতে ওরা এসে এখানে নামে, ওই সময়ে খোলা জায়গা দিয়ে ছুটে যাব আমরা।
তাহলে ভেনট্রিলোকুইস্ট হতে হবে আমাদের, তিক্ত কণ্ঠে বলল রবিন। খোলা জায়গায় গিয়ে এখানে আমাদের কথা ছুঁড়ে পাঠাতে হবে। এছাড়া আর কি করার আছে?
ঠিকই বলেছ! ঝট করে সোজা হলো কিশোর।
মানে? ভেনট্রির ভ্যা-ও জানি না আমরা। কথা ছুঁড়ব কিভাবে?
ইলেকট্রোনিক ভেনট্রিলোকুইস্টের সাহায্যে, পকেট থেকে ওয়াকি-টকিটা বের করল কিশোর। তোমারটা আছে না? গুড। আমারটা ফেলে যাব এখানে। তোমারটা দিয়ে কথা পাঠাব এটাতে।
দারুণ! এতক্ষণে হাসি ফুটল রবিনের মুখে। কথা শুনে এখানে ধরতে আসবে ওরা, ওই সুযোগে আমরা পগার পার। ওঠো, দেরি করছ কেন?
ঝোপ থেকে বেরোল দুজনে।
ওয়াকি-টকিটা মাটিতে রেখে একটা পাথর চাপা দিয়ে রিসিভারের সুইচ অন করে. রাখল কিশোর। রবিনের যন্ত্রটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল খাদের এক কিনারে, খোলা জায়গাটার দিকে।
ওই যে একটা বড় গাছ দেখছ? হাত তুলে দেখাল রবিন। তারপরেই।
শুরু হোক তাহলে, হাসল কিশোর। ওয়াকি-টকি মুখের কাছে এনে জোরে বলল, রবিন, ওরা আসছে। বলেই রবিনের মুখের কাছে ধরল যন্ত্র।
আসুক। আমাদের দেখতে পাবে না।
কান পেতে রয়েছে কিশোর, দূরের যন্ত্রটায় বেজে উঠেছে কথা, এখান থেকেও শোনা গেল মৃদু।
আরেকবার ওয়াকি-টকিত্বে কথা বলল দুজনে।
ঝোপঝাড় ভাঙার দুপটুপ আওয়াজ হলো।
শুনেছে, ফিসফিস করল রবিন। খুঁজতে যাচ্ছে।
ছোটো, বলেই লাফ দিয়ে উঠে ছুটতে শুরু করল কিশোর।
মাথা নিচু করে এক দৌড়ে বড় গাছটা ছাড়িয়ে এল দুজনে। ফিরে তাকাল একবার। লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না।
খাদের ধারে চলে এল ওরা। বেশি গভীর নয়। আসলে চওড়া একটা ফাটল, লম্বা, এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকটা গিরিপথের মত হয়ে।
তাতে লাফিয়ে নামল দুজনে।
ঢাল বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে নামল গথিক-বাড়ির পেছনের পথে। লোক দুটোর দেখা নেই।
চলো, গিয়ে ডাংম্যানকে লোকগুলোর কথা জানাই, পরামর্শ দিল কিশোর।
দ্রুত বাড়ির কোণ ঘুরে সামনে সদর দরজার কাছে চলে এল ওরা। বেল বাজাল কিশোর।
অপেক্ষা করেও সাড়া পাওয়া গেল না।
আবার বেল বাজাল।
সাড়া নেই।
দরজার নব মোচড় দিয়ে দেখল, খুলল না, তালা লাগানো।
দরজার পাশে একটা জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। লোক দেখা যাচ্ছে না।
এস্টেটে চলে গেছে হয়তো, রবিন বলল।
তা-ই হবে। চলো, ভাগি।
১১
ওত পেতেই ছিলেন মেরিচাচী, রবিন আর কিশোরকে ঢুকতে দেখেই পাকড়াও করলেন।
ওয়ার্কশপের দেয়ালে সাইকেল হেলান দিয়ে রাখল দুই গোয়েন্দা। গোপন পথ দিয়ে ঢুকেও রেহাই মিলল না।
কিশোর, কই গিয়েছিলি? সেই কখন থেকে বসে আছে তোর চাচা। এস্টেটে যাবি না?