হ্যাঁ, স্যার, আমরা ভাবছি… বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন।
মৃদু একটা শব্দ হয়েছে।
ডাংম্যানও শুনছে, চোখ কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে শব্দের উৎস আবিষ্কারের জন্যে।
বীপ-বীপ-বীপ! বীপ-বীপ-বীপ!
ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। মাপ করবেন, স্যার, আমাদের এখুনি বাইরে যেতে হচ্ছে। আসছি। রবিন, এসো।
তাড়াতাড়ি এসো, ডাংম্যান বলল। পেদ্রোজ এস্টেটে যাব। রোজই যাই মিস পেদ্রোর সঙ্গে দেখা করতে। তার সাহায্য না পেলে এখানে কিছুই করতে পারতাম না।
আসছি, স্যার, ঘুরে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। পিছু নিল রবিন।
ওয়াকি-টকি সিগন্যাল দিচ্ছে। নিশ্চয় মুসা। আশেপাশে বড় বড় বিল্ডিং। শব্দঠিকমত ধরা যাবে না। খোলা জায়গা খুঁজল কিশোর। বাগানটা চোখে পড়ল, উজ্জ্বল রোদ। একটা ঝোপের ধারে ছায়ায় চলে এল দুজনে।
হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ে সুইচ টিপল কিশোর। ফার্স্ট বলছি। সেকেণ্ড, শুনছ? ফাস্ট, শুনছ? ওভার।
শুনছি। বলো। ওভার, জবাব দিল কিশোর।
কিশোর? মুসার দুর্বল কণ্ঠ উত্তেজিত। ভূত-থেকে-ভূতে খবর দিয়েছে। এইমাত্র। একটা ছেলে লোক দুটোকে দেখেছে। ঝরঝরে গাড়িটা লা পামা স্ট্রীটের…।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ওই যে, আসছে!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। রিসিভারের বোতাম থেকে আঙুল সরে গেল, কেটে গেল বেতার যোগাযোেগ। স্তব্ধ হয়ে গেল মুসার কণ্ঠ।
সেকথা ভাবার সময় নেই এখন কিশোর আর রবিনের। ওদের সাইকেলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাদামী চামড়াদের একজন, পরনে বিচিত্র সাদা পোশাক। আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সদর দরজা আর ঝোপটার মাঝামাঝি জায়গায়। দুজনের হাতেই দুটো বড় বাঁকা ফলাওয়ালা ছুরি।
ছেলেরা ওদের দেখে ফেলতেই রওনা হলো দুজনে। ভীষণ ভঙ্গিতে ছুরি নেড়ে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
গেটের দিকে যাওয়ারও উপায় নেই, বাড়িতে ঢোকার পথও রুদ্ধ।
দৌড় দাও! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। সোজা পাহাড়ে!
১০
বাড়ির কোণের দিকে দৌড় দিল ওরা।
দ্বিধায় পড়ে গেল লোক দুজন। ক্ষণিকের জন্যে। চেঁচিয়ে উঠল গলা ফাটিয়ে।
ফিরেও তাকাল না ছেলেরা। বাগানের শেষে নিচু বেড়া লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে এসে পড়ল বাদামী পাহাড়ের গোড়ায়, পথে।
পাহাড়ে ওঠো, হাঁপাতে শুরু করল কিশোর। পরিশ্রম একেবারেই সয় না তার।
আগে ছুটছে রবিন, পেছনে কিশোর, শুকনো ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। শক্ত, ঘন, ধূসর ঝোপের ডাল তাদের কাপড় ছিড়ছে, চামড়া ছিলছে, খেয়ালই করছে না কেউ। কানে আসছে পদশব্দ। তাড়া করে আসছে দুই বাদামী। চেচাচ্ছে।
কি বলে? রবিনও হাঁপিয়ে উঠছে।
ব্যাটাদের মাথা, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর। কিচ্ছু বুঝি না।
পালাতে পারব? পারতে হবে।
আরও ওপরে উঠে সরু একটা পথ পাওয়া গেল। ঝোপঝাড় নেই। খাড়াইও অনেক কম। গতি কিছুটা বাড়ল ওদের।
ছুটছে ওরা। সরে যাচ্ছে রকি বীচ থেকে দূরে, গথিক-বাড়ি, তাদের সাইকেল পেছনে পড়ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে। ভারি হয়ে আসছে পা। পথের ওপর জোরাল হচ্ছে জুতোর আওয়াজ।
ওহ-ন্নো! চেঁচিয়ে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে গেল রবিন। তার প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়ল কিশোর। আরেকটু হলেই দিয়েছিল ধাক্কা দিয়ে ফেলে।
হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে পথ। সামনে নিচে গভীর খাদ। মাঝখানে খানিকটা খালি, তারপরে আবার পাহাড় এবং পথ।
পুল ছিল, বলল রবিন। পাহাড়ী ঢলের সময় ভেঙেছে।
ওপারে যাওয়া যাবে না। পাগলের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিশোর। এক পাশে পাহাড়ের চূড়া দেখিয়ে বলল, চলো।
বিপথে আবার ওপরে উঠতে শুরু করল ওরা। ধুলায় ধূসর চুড়া, রোদে তপ্ত হয়ে আছে। নিচে চিৎকার শোনা গেল। গোয়েন্দাদের দেখে ফেলেছে।
ফিরে তাকাল কিশোর। উঠে আসছে লোক দুজন। পাহাড়ে চড়ার অদ্ভুত ক্ষমতা। ঝোপ, পাথর, খাড়াই কোন কিছুকেই পরোয়া করছে না।
আর পারব না ওদের সঙ্গে, দাঁড়িয়ে গেল রবিন।
থেমো না!
ঘাড়ে যেন চাপড় মারছে কড়া রোদ। গরমে কটকট করছে শুকনো ডাল পাতা। ঘামে ভিজে গেছে ওদের শরীর। শুকনো চোখা ডাল হাত দিয়ে ঠেলে
সরাতে হচ্ছে বার বার, রক্তাক্ত হয়ে গেছে তালু আর আঙুল।
অবশেষে পাহাড়ের কাধে পৌঁছল ওরা। লাল ধুলোমাটির ওপরেই ধপাস করে বসে পড়ল কিশোর, হাঁ করে হাঁপাচ্ছে, আরেকটু হলেই জিভ বেরিয়ে যাবে।
ফিরে তাকাল রবিন! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আসছে!
আসুক! গুঙিয়ে উঠল কিশোর, আর পারছি না।
কপালের কাছে হাত তুলে চোখ থেকে বোদ আড়াল করল রবিন। জানের ভয়ে ছুটছি আমরা, তা-ই পারছি না, আর ওদের কাণ্ড দেখো! এক্কেবারে পাহাড়ী ছাগল। এই কিশোর, ইয়াকুয়ালি না তো? দা ভেভিলস অভ দা ক্লিফস!
কৌতূহল কিছুটা শক্তি ফিরিয়ে দিল কিশোরের দেহে। উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল সে। হতেও পারে। এজন্যেই কথা বুঝি না। ইয়াকুয়ালি বলেই হয়তো।
এসকিমো ভাষা বলুকগে, আমার কিছু না, আমার এখন পালানো দরকার, চঞ্চল হয়ে উঠল রবিন। যাই কোথায়? আচ্ছা, ডাংম্যানই আমাদের ধরতে পাঠাল না তো?
মনে হয় না, দূরে গথিক-বাড়িটার দিকে তাকাল কিশোর। শান্ত। কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
সাইকেলের কাছে যদি খালি ফিরতে পারতাম!
সামনে কোথায় যাব? পাহাড়ের শূন্য কাঁধের দিকে তাকাল রবিন, শুকনো ঝোপ ছাড়া আর কিছু নেই। লুকানোর কোন জায়গায়ই চোখে পড়ছে না। দেখতে দেখতে হঠাৎ উজ্জ্বল হলো তার মুখ। কিশোর, পেয়েছি! এসো।