হুকের ছিদ্র দিয়ে দড়ির এক মাথা ঢুকিয়ে শক্ত করে বাঁধল কিশোর, ছুঁড়ে দিল ওপর দিকে। দেয়ালের ওপরে আটকে গেল হুকের একটা কাটা। দুজনে মিলে দড়ি ধরে টেনে দেখল, খুলে আসছে না।
দড়ি বেয়ে আগে উঠে গেল মুসা। উঁকি দিয়ে দেখল ওপাশে। উঠে বসে ফিরে চেয়ে কিশোরকে ওঠার ইঙ্গিত করল।
উঠে এল কিশোর।
দেয়াল থেকে হুকটা খুলে নিয়ে দড়ি গুটিয়ে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল কিশোর। দুজনে লাফিয়ে নামল এস্টেটের সীমানার ভেতরে। ব্যাগটা একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।
বাড়িটাতে ঢুকব, বলল কিশোর। খুব সাবধান।
ম্লান হয়ে আসছে সাঁঝের আলো। গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আড়ালে সাবধানে এগোল ওরা। ছোট একটা টিলায় উঠে থামল, এখান থেকে মূল বাড়ি আর গোলাঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়। চোখ রাখা যাবে।
দিনের আলো শেষ, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে যেন অন্ধকার। আলো জ্বলে উঠেছে বাড়িটার ঘরে ঘরে। জানালার শার্সিতে মানুষের ছায়া, কিন্তু কেউ বেরোল না, ঘরের ভেতরেই হাঁটাচলা করছে। চারদিক শান্ত। দূরে রাস্তার দিক থেকে কদাচিত ভেসে আসছে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ।
এক জায়গায় একই ভঙ্গিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থেকে শরীর ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, জমে যাচ্ছে যেন মাংসপেশী। মুসার একটা পা প্রায় অবশ, মৃদু ডলাডলি করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করে নিল।
কিশোর নড়ল না, পড়ে আছে তো আছেই। স্থির, পাথরের মূর্তি যেন।
সময় যাচ্ছে।
এক সময় বাড়ির নিচতলার আলো নিভে গেল। চাঁদ নেই আকাশে। আরও ঘন হলো অন্ধকার।
হঠাৎ, মুসার বাহুতে হাত রাখল কিশোর।
কি? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল অবাক মুসা।
ওই যে!
লম্বা, আবছা একটা মূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে বাড়িটার দিকে। দাঁড়িয়ে পড়ল, কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে বোধহয়, তারপর আবার চলতে শুরু করল। গোলাঘরের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে পুবের বনের দিকে।
ও বনে ঢুকলেই আমরা… কথা আর শেষ করতে পারল না কিশোর।
তীক্ষ্ণ, তীব্র, বুনো হাসি ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে, খান খান করে দিল যেন আঁধার রাতের স্তব্ধ নীরবতা।
৮
চিড়িয়াখানায় অন্ধকারে হায়েনার হাসি শুনেছে কিশোর, হাসিটা অনেকটা সেরকম লাগল তার কাছে।
ওটাই! গলা কেঁপে উঠল মুসার। ভূতের ছায়া। আজ অন্যরকম লাগছে!
মানে?
সেদিনের মত কুঁজো নয়। তবে হাসিটা একরকম।
জলদি করা দরকার। নইলে হারিয়ে ফেলব। চলো।
উঠে, টিলার উল্টো ধার দিয়ে দ্রুত নেমে এল ওরা। বনের দিকে ছুটল। যে পথ ধরে ছায়াটা গেছে, সে-পথ ধরে। যতখানি কাছে থেকে স্তব অনুসরণ করতে চায়।
ফিরে তাকাল না ছায়াটা, লম্বা লম্বা পা ফেলে একভাবে এগিয়ে চলেছে। থেমে গেছে বুনো হাসি।
মাইলখানেক পর ঘন হতে শুরু করল বন। এগিয়েই চলেছে ছায়া। আরও খানিকদ্দূর এগিয়ে মোড় নিল, মূল পথ থেকে সরে গেল একটা গলিপথে।
সরু এই পথটা গিয়ে পড়েছে বাটি-আকৃতির ছোট একটা উপত্যকায়। খোয়া বিছানো কাঁচা পথ চলে গেছে উপত্যকার বুক চিরে, পথের শেষ মাথায় ছোট, পুরানো একটা কাঠের বাড়ি। চারপাশে ঘেরা বারান্দা, খড়খড়ি লাগানো জানালা, পাথরে তৈরি চিমনি।
শিকারীর বাংলো গোছের কিছু, বলল কিশোর। হান্টিং লজ।
দেখো!
আড়াল থেকে বেরিয়ে কালো মস্ত আরেকটা ছায়া এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। আরও কাছে আসার পর কানে এল এঞ্জিনের শব্দ। ট্রাক, হেডলাইট নিভানো। যেন উড়ে এসে ট্রাকটা থামল ছায়ামূর্তির কাছে, কেবিন থেকে লাফিয়ে নামল বেঁটে, ভারি একটা লোক। দ্রুত, চাপা গলায় কথা হলো কিছু, তারপর ঘুরে ট্রাকের পেছনে গিয়ে টেইল-বোর্ড নামাল লোকটা।
পেছন থেকে নামল চারটে বেঁটে মূর্তি।
ওদেরকে এক সারিতে দাঁড় করাল লোকটা। আগে আগে বাড়িটার দিকে চলল, সে, পেছনে অন্যেরা।
লম্বা ছায়াটা আগেই গিয়ে উঠেছে বারান্দায়। আলো জ্বেলে দিল।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। কি ওগুলো?
খুবই বেঁটে চারটে মূর্তি, মাথা নেই।
মাথা! মাথা গেল কই! গলা কাঁপছে মুসার।
আ-আমি জানি না! কিশোর পাশাও কথা হারিয়ে ফেলেছে। ও-ওরা, মনে তো হচ্ছে, মুশূন্য বামন…
অন্ধকারে একে অন্যের মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল দুই কিশোর।
হচ্ছে কি এখানে? মুসার জিজ্ঞাস।
জানি না, গলা শুকিয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধানের। কাছে গেলে বোঝা যাবে। চলো, জানালা দিয়ে উঁকি দিই।
ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল দুজনে।
হঠাৎ আবার বিস্ফোরিত হলো যেন ভয়াল হাসি, ঠিক তাদের পাশে।
কোনরকম ভাবনা-চিন্তার অবকাশ নেই আর। পাঁই করে ঘুরে দিল দৌড় দুজনে, যে পথে এসেছে, সে-পথে। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হারিয়েছে।
উত্তেজিত হয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরোল রবিন। জবর খবর জেনেছে।
দ্রুত হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল সে। কিন্তু মুসা আর কিশোর ফেরেনি। এলেই যেন বাড়িতে ফোন করে, ওদের জন্যে মেসেজ রেখে বেরিয়ে এল রবিন। বাড়ি চলল।
টেলিভিশনে স্থানীয় সংবাদ শুনছেন মিস্টার মিলফোর্ড। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা বিশিষ্ট পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেন তিনি, কাজেই রেডিওটেলিভিশনের যে কোন খবর শোনা পারতপক্ষে বাদ দেন না। বাড়িতে থাকলে তো নয়ই।
রান্নাঘরে মাকে খুঁজে পেল রবিন।
এক গ্লাস দুধ আর কয়েকটা বিস্কুট এগিয়ে দিলেন মিসেস মিলফোর্ড। লাইব্রেরি থেকে এলি?
হ্যাঁ, বলল রবিন। মা, কিশোর কোন মেসেজ দিয়েছে?